শতকোটি টাকার ব্যবসায় অশনি সংকেত, যাত্রীর জন্য হাহাকার লঞ্চঘাটে

বাংলাদেশ

বরিশাল প্রতিবেদক
10 April, 2024, 08:55 pm
Last modified: 10 April, 2024, 09:50 pm
সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রিয়াজুল কবির বলেন, “ঈদের আগে ‘সুরভী-৯’ লঞ্চটি মাত্র একটি ট্রিপ পেয়েছে। বাকি সব নিয়মিত সার্ভিস। আমরা অনেক কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করছি। লঞ্চের যাত্রী একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কম টাকায় সড়ক পথে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা আর লঞ্চের দিকে ফিরবে বলে মনে হয় না। ফলে লঞ্চ ব্যবসাও সংকুচিত হয়ে গেছে।”

"ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের 'এমভি কুয়াকাটা-২' লঞ্চে আগে করনিক ছিলেন পাঁচজন এবং সুপারভাইজার তিনজন। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর এই রুটে যাত্রী কমে যাওয়ায় লঞ্চের ট্রিপ কমেছে। সেইসঙ্গে কমেছে আয়ও। বর্তমানে পাঁচজন করনিকের জায়গায় কর্মচারী ছাঁটাই করে রাখা হয়েছে দুইজনকে। সুপারভাইজার আছেন মাত্র একজন। এই রুটের নৌযান সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়েছেন।"

"পদ্মা সেতু চালুর আগে 'কুয়াকাটা ২' লঞ্চটির কেবিনের জন্য শত শত যাত্রীর হাহাকার ছিল। সময়ের পরিক্রমায় অধিকাংশ কেবিন এখন ফাঁকা থাকে। বরং লঞ্চ স্টাফরা এখন যাত্রীর জন্য হাহাকার করেন।"

বুধবার (১০ এপ্রিল) বিকালে বরিশাল নদী বন্দরে নোঙর করে রাখা লঞ্চের ডেকে বসে আফসোস করে কথাগুলো বলছিলেন 'এমভি কুয়াকাটা-২' লঞ্চের করনিক মাধব মিত্র।

নৌ-রুটে ব্যবসার উত্থান-পতন অনেক দেখেছেন। কিন্তু এভাবে বিলুপ্তির মুখোমুখি হতে হবে তার শঙ্কা কখনো করেননি।

মাধব মিত্র বলেন, "ঈদের বিশেষ সার্ভিসে ৯ এপ্রিল যাত্রা করে ১০ এপ্রিল বরিশাল বন্দরে পৌঁছেছি, ১১ এপ্রিল ঈদ। ঈদের আগের দিনে যাত্রী হওয়ার কথা ছিল প্রতি ট্রিপে ৭/৮ হাজার। কিন্তু আমাদের মাত্র সাতশ' ডেকের যাত্রী, আর তিনশ' কেবিনের মধ্যে দুইশ' কেবিন ফাকা নিয়েই আসতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, "পদ্মা সেতু চালুর আগে যাত্রীদের যেমন ঢল নামতো, এখন আর যাত্রীদের চাপ নেই। প্রায় ৮০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে। আমরা উৎসব ঘিরে মাত্র ২০ শতাংশ যাত্রী পাচ্ছি। এছাড়া বছরের অধিকাংশ সময়েও লঞ্চ কর্মচারীদের অবসরেই থাকতে হয়।" 

শুধু মাধব মিত্র নন, অসহায়ত্বের কথা জানালেন 'সুরভ- ৯' লঞ্চের ড্রাইভার আবু তালেব খান। 

ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর মধ্যে অন্যতম বিলাসবহুল এই লঞ্চটিও তার কর্মচারী কমিয়েছেন আয় কমে যাওয়ায়।

আবু তালেব বলেন, "পদ্মা সেতু হওয়ার আগে লঞ্চ স্টাফরা যাত্রী পারাপারে যেভাবে ব্যস্ত থাকতাম, পদ্মা সেতু হওয়ার পরে আমরা বলতে গেলে সবসময়েই অবসরে থাকি। সারা বছরে ঈদের আগে দুই-একদিন কাঙ্ক্ষিত যাত্রী পাই।"

আবু তালেব খান বলেন, "ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে বিলাসবহুল এমন কয়েকশ' লঞ্চের শতকোটি টাকা মুনাফা খাটিয়েও যাত্রী না পাওয়ায় লঞ্চ মালিকরা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। সাথে সাথে লঞ্চ শ্রমিকরাও সব হারিয়ে ফেলছি।" 

'এমভি কীর্তনখোলা-১০' লঞ্চের গ্রিজার আল আমিন বলেন, "লঞ্চ ব্যবসায় আগে লাভ থাকলেও একটা সেতুর কারণে পুরো শিল্পটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য খুবই উপকারে এসেছে। কিন্তু এই উপকারের আড়ালের সত্যটা হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চ সংশ্লিষ্ট মালিক থেকে কর্মচারী সকলেই আজ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছি।"

উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, "কীর্তনখোলা লঞ্চটি বরিশাল থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে ট্রিপ নিয়ে বরিশালে ফিরতে শুধুমাত্র সাড়ে ৭ লাখ টাকার ডিজেল খরচ দিতে হয়। এছাড়াও এক ব্যারেল ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করতে হয়, যার বাজার মূল্য ৪২ হাজার টাকা। অথচ আপ-ডাউনের (যাওয়া-আসা) ট্রিপে সর্বোচ্চ দেড় হাজার যাত্রীও পাওয়া যায় না। কেবিনগুলো খালি থাকছে। পদ্মা সেতু চালুর আগে আপ-ডাউনে তিন হাজার যাত্রী পাওয়া যেত নূন্যতম। এখন এক হাজার যাত্রী পেতে কষ্ট হয়। ঈদ স্পেশাল সার্ভিসের প্রতি ট্রিপে ৭/৮ হাজার যাত্রী পেতাম। এখন ডেকে পাঁচশ' যাত্রী উঠাতে ঘাম ঝড়াতে হয়।"

এই নৌযান শ্রমিক মনে করেন, পদ্মা সেতুর পাশাপাশি নৌ সেক্টরকে রক্ষায় সরকার উদ্যোগ না নিলে হাজার কোটি টাকার সচল এই অর্থনৈতিক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।

নদী বন্দরে টিকেট সংগ্রহ করতে এসেছিলেন মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, "আগামীকাল ঈদ, এমন সময়ে মাত্র তিন বছর আগেও ফিরতি টিকেট পাওয়ার কথা কল্পনাও করা যেত না। আমি আজ এসে লঞ্চ থেকে টিকেট নিলাম ঈদের চারদিন পরের। নির্ধারিত ভাড়া রেখেছে, আর কোনো ভিড়ও ছিল না। নদী বন্দর যেন সুনসান নীরব।"

সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রিয়াজুল কবির বলেন, "ঈদের আগে 'সুরভী-৯' লঞ্চটি মাত্র একটি ট্রিপ পেয়েছে। বাকি সব নিয়মিত সার্ভিস। আমরা অনেক কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করছি। লঞ্চের যাত্রী একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কম টাকায় সড়ক পথে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা আর লঞ্চের দিকে ফিরবে বলে মনে হয় না। ফলে লঞ্চ ব্যবসাও সংকুচিত হয়ে গেছে।"

বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানিয়েছে, ঈদকে ঘিরে চলতি বছর দিনে ৬টি করে লঞ্চ যাত্রী পারাপার করবে। যাত্রীর চাপ বাড়লে সেই সংখ্যা বাড়ানো বা চাপ না থাকলে সংখ্যা কমানো হতে পারে। 

এছাড়া নিয়মিত ট্রিপে দুটি করে লঞ্চ চলাচল করে। পদ্মা সেতু চালুর আগ পর্যন্ত সর্বশেষ ২০২১ সালেও ঢাকা-বরিশাল বিশেষ সার্ভিস চালু হতো মহা সমারোহে। নিয়মিত লঞ্চের পাশাপাশি অন্তত ১৪টি ঈদ সার্ভিস চলত যাত্রী চাপ সামাল দিতে। নদী বন্দরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নৌযান শ্রমিকরা যাত্রীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতো। অথচ সেই চিত্র যেন হারানো অতীত।

বরিশাল সদর নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল বলেন, "যাত্রীদের নিরাপত্তায় নৌপুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সকল বাহিনীই নদী বন্দরে দায়িত্ব পালন করছেন। যাত্রীরা নিরাপদে যেন বাড়িতে ফিরতে পারেন তার নিশ্চিত করছি আমরা। এই পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, পূর্বের তুলনায় কমে গেছে যাত্রীদের চাপ।"

বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "ছয়টি নির্ধারিত থাকলেও চারটি করে লঞ্চ আসছে। গতবছরও যে পরিমাণ যাত্রী ছিল, এবার তা আরও কমে গেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সহজেই মানুষ বাড়ি ফিরতে পারে, এজন্য দীর্ঘ সময়ের লঞ্চ যাত্রা অনেকে পছন্দ করছেন না। যাত্রীদের নিরাপত্তা, ঈদ স্পেশাল সার্ভিসের সব প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া। কিন্তু যাত্রী কম থাকায় খুব বেশি ব্যস্ততা নেই নদী বন্দরে।"

উল্লেখ্য, ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে ঈদের স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিস।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.