নিরাপত্তার শঙ্কায় বান্দরবানে পর্যটকদের বুকিং কম

বাংলাদেশ

09 April, 2024, 03:10 pm
Last modified: 09 April, 2024, 05:34 pm

এবার ঈদ, বিজু ও সাংগ্রাই উৎসব একসাথে হওয়ায় পর্যটকদের অনেকেই পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠা হোটেল ও রিসর্টগুলোও প্রস্তুতি নিয়েছিল পর্যটকদের আথিতেয়তার। কিন্তু পাহাড়ের বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুট, কর্মকর্তা অপহরণসহ সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ঈদ ও বিজু উৎসবের ছুটির আগমুহূর্তে এই হামলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌন্দর্যে মোড়া পাহাড়ে অবস্থিত হোটেল ও রিসর্টগুলো পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার আশা করছিল, কিন্তু কেএনএফের আক্রমণ পর্যটকদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অগ্রিম বুকিং বাতিল করছেন অনেকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং রোববার থেকে গতকাল সোমবার (৮ এপ্রিল) পর্যন্ত পৃথক অভিযানে অন্তত ৫৩ জন 'কেএনএফ সদস্য'কে আটক করেছে।

হোটেল ও রিসর্টগুলো ৩০ শতাংশ ছাড় দিয়েও পর্যটক পাচ্ছে না। ফলে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

হোটেল হিল ভিউ বান্দরবানের কর্মকর্তা মোহম্মদ লিমন বলেন, 'আমরা আশা করছিলাম এবার আমাদের ব্যবসা ভালো হবে। তবে এখন এত বিনিয়োগ নিয়ে ঝুঁকিতে আছি। অগ্রিম বুকিং এখন মাত্র ২৫ শতাংশ আছে। এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি না হলে ৮০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং থাকতে। এই পিক সিজনেও ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েও নতুন করে অগ্রিম বুকিং পাচ্ছি না। কেউ কেউ ফোন দিয়ে জানতেন চাচ্ছে কী অবস্থা, কিন্তু বুকিং নিচ্ছেন না।'

দীর্ঘদিন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লম্বা সময় ধরে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন জেলার পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ফলে দীর্ঘ সময় পর পর্যটন ব্যবসায় লাভের আশা করছিলেন তারা। কিন্তু এবার এলো আরেক সংকট।

বান্দরবান হোটেল-মোটেল-রিসর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের  সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ হোটেলে এখন ৫০ শতাংশ বুকিং আছে। অথচ ঈদের সময় সাধারণত ৮০ শতাংশ বুকিং থাকে।

তিনি বলেন, 'এটি পর্যটন খাতের জন্য বিরাট ধাক্কা। শুধু রুমা আর থানচিতেই ১০০-র বেশি হোটেল ও রিসর্ট আছে। আমাদের ধারণক্ষমতা ৬ হাজারের মতো। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যটকরা আসছেন না।'

তবে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পর্যটকদের বান্দরবানে ঘুরতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'পর্যটকরা সাধারণত যেসব স্পটে ভ্রমণ করে, ওইসব স্পটে কোনো সমস্যা দেখছি ন। এগুলো ঝুঁকিমুক্ত এলাকা।'

পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের হোটেল হচ্ছে হোটেল ডিসকভারি থানচি অ্যান্ড তং মা হাং রেস্টুরেন্ট। আসন্ন ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে গত ১ এপ্রিলের আগেই হোটেলটির প্রায় ৭০ শতাংশ রুম অগ্রিম বুকিং হয়ে যায়। কিন্তু কেএনএফের সশস্ত্র হামলা ও ব্যাংক লুটের ঘটনায় হোটেলের সব বুকিং বাতিল করেছেন পর্যটকরা।

হোটেলটির কর্ণধার ও থানচি রিসর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'পর্যটক এবং বুকিং তো অনেক দূরে, নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা হোটেলের স্টাফদেরও অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।'

তিনি জানান, ঈদের ছুটিতে থানচিতে প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ হাজার পর্য়টক আসে। উপজেলায় ছোট-বড় ২৫টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে, যাতে তারা রাত্রিযাপন করে। কিন্তু বুকিং বাতিলের কারণে হোটেল ও রিসর্টগুলো ব্যাপক লোকসানে পড়েছে।

থানচির নামকরা ইকো-রিসর্ট থানচি কুটির। রিসর্টের ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, ঈদের পরের টানা চারদিন পর্যন্ত তাদের হাউসফুল বুকিং ছিল। কিন্তু হামলার পর থেকে সব বুকিং বাতিল করা হয়েছে। তাদের কুটির এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। এমনকি কবে নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হবে এবং ফের ব্যবসায় ফিরবে, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। সহসা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। 

রুমা উপজেলা সদরের হোটেল মায়া কুটিরের পরিচালক আবু ছিদ্দিক বলেন, স্থানীয় হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। ঈদের ছুটিতে পর্যটক যদি না আসে, তবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে এসব প্রতিষ্ঠান। 

বান্দরবান হোটেল ও রিসর্ট মালিক সমিতির সভাপতি অমল দাশ বলেন, পর্যটকদের আতিথেয়তা দিতে বান্দরবান জেলায় গড়ে উঠেছে ২০০ টির মত হোটেল-রিসর্ট ও অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ একসাথে হওয়ায় ভালো ব্যবসা করার প্রস্তুতি ছিল হোটেল মালিকদের। সে উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণে অগ্রিম বুকিংও পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু রুমা ও থানচির ঘটনার পর অনেকেই বুকিং বাতিল করছেন। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে লাভের পরিবর্তে উল্টো লোকসান হওয়ার আশঙ্কায় আছেন তারা।

বান্দরবনের নিলাচলে অবস্থিত ইকোসেন্স রিসর্টের পরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বান্দরবান সদর থেকে রুমার দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার, থানচির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু সেখানে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার প্রভাব পুরো জেলার ওপরই পড়বে। এভাবে চলতে থাকলে অনেক হোটেল ও রিসর্ট মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন বলে মনে করছেন তিনি। 

তবে সাইরু হিল রিসর্টের ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার জাহিদ হাসান বলেন, বান্দরবান সদরের কাছাকাছি অবস্থানে হওয়ায় তাদের হোটেলে বুকিং বাতিলের প্রভাবটা কম। তবে ঈদের আগে আরও যেভাবে রুমগুলো বুকিং হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। 

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রায়হান কাজেমী বলেন, সাম্প্রতিক হামলার পর বান্দরবানের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। 

'থানচি ও রুমার উপজেলা সদরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের সতর্ক পাহারা রয়েছে। আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে এই মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম এলাকায় হোটেল-রিসর্টগুলো বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে,' বলেন তিনি।

থানচি উপজেলা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান অং প্র মোরং বলেন, সশস্ত্র হামলা ও গোলাগুলির ঘটনায় এলাকাবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বান্দরবান শহরের দিকে চলে গেছেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।

রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে প্রভাব পড়েনি

রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে অবশ্য বুকিংয়ে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ঈদে পুরোদমে পর্যটক আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা। 

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের  সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, নিরাপত্তা পর্যটনের অন্যতম শর্ত। বান্দরবানের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে গেছে, তাই সেখানে পর্যটক কম যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বান্দরবানে কম গেলেও রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে স্বাভাবিকভাবেই বেশিসংখ্যক পর্যটক যাবে। 

হোটেল হিল হেভেন খাগড়াছড়ির মালিক এবং খাগড়াছড়ি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির অর্থসম্পাদক জহিরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বান্দরনে যারা অগ্রিম বুকিং করেছিলেন, কেউ কেউ সেটি বাতিল করে খাগড়াছড়িতে বুকিং দিচ্ছেন। তার হোটেলে ৯ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বুকিংয়ের চাপ আছে। তার হোটেলে ইতিমধ্যে ৬০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। 

পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স রাঙ্গামাটির ম্যানেজার বলেন, এখানে ১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৮০ শতাংশ বুকিং হয়ে গেছে। কেএনএফের হামলার কোনো প্রভাব নেই এখানে। 

টুরিস্ট পুলিশ প্রধান ডিআইজি আবু কালাম সিদ্দিক শনিবার বলেছেন, বান্দরবানে গত কয়েকদিনে ব্যাংকে ডাকাতি, অপরহণ ও হামলার ঘটনার প্রভাব দেশের পর্যটন খাতের ওপর পড়বে না । পহেলা বৈশাখে পর্যটন পুলিশ সমস্ত পর্যটন কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেবে।

কেএনএফের ৫৩ সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

রোববার ও সোমবার পৃথক অভিযানে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৩ জন কেএনএফ সদস্যকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আটকদের মধ্যে ১৮ জন নারী। অভিযানে রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকের সহকারী ক্যাশিয়ার লালচিয়াম বমকেও গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা ইউএনবি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এছাড়া অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও কেএনএফ-সংক্রান্ত সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।

রুমা উপজেলায় সেনাবাহিনীর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম আরাফাত আমিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.