জ্বালানির বকেয়া পরিশোধে জরুরিভিত্তিতে ১ বিলিয়ন ডলার ও ৯ হাজার কোটি টাকা চায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ

04 April, 2024, 10:50 am
Last modified: 04 April, 2024, 04:29 pm
বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সূত্র অনুসারে, তেল ও গ্যাসের বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছে বকেয়া ঋণ বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ১.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেল সরবরাহকারীরা ২৮০ মিলিয়ন ডলার এবং গ্যাস ও এলএনজি সরবরাহকারীরা পাবে ৩২০ মিলিয়ন ডলার।

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সম্প্রতি তেল ও গ্যাস আমদানি বৃদ্ধির কারণে ডলারের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে। ফলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জরুরিভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা) চেয়েছে।

তেল-গ্যাস আমদানিতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা স্বাভাবিকভাবে সরবরাহ করা হয়, তার বাইরে এ অর্থ চায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যেন তাদের ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারে, সেজন্য নয় হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করারও প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয়টি।

বুধবার (৩ এপ্রিল) এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।

বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন।

বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সূত্র অনুসারে, তেল ও গ্যাসের বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছে বকেয়া ঋণ বেড়ে ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ১.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেল সরবরাহকারীরা ২৮০ মিলিয়ন ডলার এবং গ্যাস ও এলএনজি সরবরাহকারীরা পাবে ৩২০ মিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ মেটাতে প্রয়োজনীয় বাড়তি ডলারের ঘাটতি রয়েছে।

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহের বকেয়া স্থানীয় মুদ্রায় বন্ডের মাধ্যমে মেটানো গেলেও বিদেশি বকেয়ার জন্য মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। যদি অতিরিক্ত ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায় তবে এটি ভবিষ্যতে গত বছরের ডিসেম্বরের মতো জ্বালানি আমদানিতে সংকটের কারণ হতে পারে, বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ডলার পাওয়া চ্যালেঞ্জ

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সাম্প্রতিক জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে লাভ করেছে এবং এটির অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলারের বেশি সরবরাহ না করায় জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।

বিপিসি সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রতি মাসে ১৭ থেকে ১৮টি এলসি খোলা হয়। এসব এলসিতে গড়ে খরচ হয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যায়। ফলে বাকি অর্থ বকেয়া থেকে যায়, যা পরিশোধে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগে।

গত বছরের ডিসেম্বরে বেশ কয়েকটি বিদেশি সরবরাহকারী তাদের পাওনা পরিশোধ না করলে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেবে বলে জানিয়েছিল। এলএনজি এবং কয়লা সরবরাহের ক্ষেত্রেও একই রকম পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট কয়েক দফায় বন্ধ ছিল।

জাতীয় নির্বাচনের সময় সরবরাহকারীরা প্রাথমিকভাবে এ সতর্কতামূলক অবস্থান গ্রহণ করলেও, সম্প্রতি বকেয়া বাড়া সত্ত্বেও তারা সরবরাহ বন্ধ রাখার অবস্থান শিথিল করেছে। তবে সরবরাহকারীরা এখন বিলম্ব মাশুল দাবি করছে।

২০২৩–২৪ অর্থবছরে জ্বালানি বিভাগ জ্বালানি তেল এবং এলএনজি আমদানির জন্য জেদ্দাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। এছাড়া বিভাগটি আসন্ন অর্থবছরের জন্য আইটিএফসি থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চূড়ান্ত করেছে। এগুলো সবই নন-কনসেশনাল অর্থাৎ বাজারভিত্তিক সুদের ঋণ।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া

সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে দামে বিদ্যুৎ কেনে, তার চেয়ে কম দামে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। এতে সৃষ্ট ঘাটতি সরকার ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করে। অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকি বরাদ্দের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া নিষ্পত্তি করা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়ায় অর্থ বিভাগ সময়মতো ভর্তুকি ছাড়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা পাবে। অন্যদিকে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাংকঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যাতে ঋণখেলাপি না হয়, সে জন্য অর্থ বিভাগ এসব ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য বন্ড ইস্যু করছে।

এর আগে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য ছয় হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছিল সরকার। প্রায় ২৪টি ব্যাংক এসব বন্ড পেয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক

মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান, জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম ছাড়াও পিডিবি, বিপিসি ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর নসরুল হামিদ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পরদিন বৈঠকের জন্য অনুরোধ করেন।

বুধবার অর্থমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব, জ্বালানি সচিব, অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারসহ উভয় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা বিদ্যুৎ ভর্তুকি তহবিল দ্রুত ছাড়, ভারতের আদানি গ্রুপ এবং অন্যান্য বিদেশি ঋণদাতাদের বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা করেছি। এছাড়া ভর্তুকি চাপ কমাতে কোম্পানিগুলো কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল।'

'বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের দুটি কোম্পানি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। স্টক মার্কেটে অন্যান্য কোম্পানিগুলোকে কীভাবে তালিকাভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে,' তিনি আরও বলেন।

তবে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম বলেন, 'এটি একটি বিশেষ মিটিং ছিল। এ মুহূর্তে আর কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।'

তাপমাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে লোডশেডিংও

গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার আগেই দেশে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। যার ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং হচ্ছে।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দিনের পিক টাইমে ১০ হাজার ৮৫৪ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার পিক টাইমে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৮৯৮ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছে। ওই দিন ৪০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ছিল না, আর ৩৩টি আংশিকভাবে চালু ছিল।

এছাড়া ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে থাকায় সেগুলো বর্তমানে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

দেশে মোট ১৭৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জ্বালানি ঘাটতির কারণে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী দিনে তাপমাত্রা আরও বাড়বে। বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.