অ্যানেসথেসিয়ার জটিলতায় রোগীর মৃত্যু কী কারণে?

বাংলাদেশ

27 March, 2024, 10:00 am
Last modified: 27 March, 2024, 01:11 pm
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নকল হ্যালোথেন নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেরিতে পদক্ষেপের কারণে অ্যানেসথেসিয়া সংক্রান্ত জটিলতা এবং মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

গত ১৮ মার্চ টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের একটি বেসরকারি হাসপাতাল আলোক হেলথকেয়ারে পাইলস অপারেশনের জন্য অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হলে খিঁচুনি শুরু হয়ে হোসনে আরা নামক এক রোগীর মৃত্যু হয়।

১৯ মার্চ ঢাকার কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের পর আর চেতনা ফেরেনি ১২ বছর বয়সি রোগী তাসফিয়া জামান তনয়ার। এ ঘটনায় হাসপাতালের চার চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এগুলো স্রেফ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত তিন মাসে অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করে অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়ায় পর দেশব্যাপী ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এ ধরনের মৃত্যু বাড়ার জন্য চিকিৎসকেরা বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন। এর মধ্যে রয়েছে অ্যানেসথেসিয়ার জন্য আগে বহুল ব্যবহৃত ওষুধ হ্যালোথেন উৎপাদন বন্ধ হওয়া এবং বাজারে নকল হ্যালোথেনের উপস্থিতি।

অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেসথেসিয়ার জন্য ব্যবহৃত ব্যয়সাশ্রয়ী ওষুধ হ্যালোথেনের ক্ষতিকর শারীরিক ও পরিবেশগত প্রভাবের কারণে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এটি নিষিদ্ধ করেছে।

দেশে হ্যালোসিন ব্র্যান্ড নাম দিয়ে হ্যালোথেন উৎপাদন করত এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস। গত বছর বাংলাদেশে এটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

তবে কিছু হাসপাতালে হ্যালোথেন মজুত ছিল। মজুত কমে যাওয়ায় ঘাটতি মেটানোর চাহিদায় ভারত থেকে নকল হ্যালোথেন দেশের বাজারে ঢোকার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাজারে ভেজাল হ্যালোথেনেরও দেখা মিলেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নকল হ্যালোথেন নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেরিতে পদক্ষেপের কারণে অ্যানেসথেসিয়া সংক্রান্ত জটিলতা এবং মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কাওসার সরদার বলেন, 'আমরা ২০২৩ সালের জুলাই মাসে স্বাস্থ্য বিভাগকে দেশে হ্যালোথেনের অপর্যাপ্ততার কথা জানিয়ে বিকল্প ওষুধ ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পর ৬ আগস্ট হাসপাতালগুলোর পরিচালক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ৫টি প্রস্তাবের রূপরেখার চিঠি পাঠানো হয়।'

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানদের এ সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের জন্য সুপারিশ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।


আরও পড়ুন: অ্যানেস্থেশিয়ার ওষুধ হ্যালোথেনের উৎপাদন বন্ধ করল এসিআই, অস্ত্রোপচারের খরচ বাড়ার শঙ্কা


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সঙ্গে সম্প্রতি এক বৈঠকে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট বাজারে নকল হ্যালোথেনের উপস্থিতির কথা জানিয়ে এটিকে সাম্প্রতিক অ্যানেসথেসিয়াজনিত মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।

সোসাইটি সভায় অননুমোদিত হ্যালোথেন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে হ্যালোথেনের নিরাপদ বিকল্প যেমন আইসোফ্লুরেন এবং সেভোফ্লুরেনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভ্যাপোরাইজার ব্যবহারের সুপারিশ করে।

পাশাপাশি সোসাইটি বিদ্যমান হ্যালোথেন ভ্যাপোরাইজারের বদলে জরুরিভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে আইসোফ্লুরেনের ব্যবহার, বিকল্প ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং আইসোফ্লুরেনের খরচ কমানোর জন্য ওষুধ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার পরামর্শ দেয়।

সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি ডা. দেবব্রত বণিক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ধারণা করছি, ভারত থেকে আমদানি করা হ্যালোথেনে ভেজাল রয়েছে। এছাড়া আমাদের হাসপাতালগুলোতে যে হ্যালোথেনের মজুত আছে, কালোবাজারির জন্য সেগুলোর একটি বোতল থেকে ভেজাল মিশিয়ে দু-তিনটি বোতল করা হচ্ছে। যেহেতু বাজারে চাহিদা আছে; দেড় হাজার টাকার হ্যালোথেন পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের এ অধ্যাপক জানান, সন্দেহভাজন নকল হ্যালোথেনের কিছু নমুনা পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে এসব পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা।

পদ্ধতির পরিবর্তন চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

এ সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশব্যাপী অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার পদ্ধতিতে পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়েছে।

অধিদপ্তর জানিয়েছে, আইসোফ্লুরেন এবং সেভোফ্লুরেনে স্থানান্তর সহজ করার জন্য উপযুক্ত ভ্যাপোরাইজার কিনতে এবং বিদ্যমান হ্যালোথেন মডেলসমূহ পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে।

এছাড়া অননুমোদিত হ্যালোথেনের ব্যবহার মোকাবিলা করা এবং নিরাপদ বিকল্প ওষুধগুলোয় স্থানান্তরিত হতে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের সঙ্গে দেশব্যাপী ভার্চুয়াল মিটিং এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে মেশিনের দাম বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ ছোট বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিকল্প চেতনানাশক ভেপোরাইজার থাকে না।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো ভারত থেকে আমদানি করা ভেজাল হ্যালোথেন ব্যবহার করছে।

নোয়াখালী সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (অ্যানেসথেসিওলজিস্ট) ডা. আবু তাহের অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহারের জটিল সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।

'আমার অঞ্চলের মাত্র ১ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালে হ্যালোথেনের বিকল্প ওষুধের মেশিন রয়েছে। তাছাড়া আমরা বাজারে নতুন বোতলে নকল হ্যালোথেন দেখতে পাচ্ছি,' তিনি বলেন।

এ জাল বোতলগুলোর লেবেলে গন্ডগোল ও নড়বড়ে ছিপি দেখেই এগুলো শনাক্ত করা যায়। যদিও তার হাসপাতাল এসব হ্যালোথেন ব্যবহার করে না, তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, দেশব্যাপী অনেক বেসরকারি হাসপাতাল হয়তো এগুলো ব্যবহার করছে।

ডা. আবু তাহের অস্ত্রোপচারের পরে ব্যবহৃত জাল ব্যথার ওষুধের কথাও উল্লেখ করেন। যদিও তিনি মনে করেন, এগুলো প্রাণঘাতী নাও হতে পারে, তবে এসব ভেজালযুক্ত ওষুধ ব্যবহারে রোগীদের জটিলতা বাড়ছে।

'প্রতিদিন আট থেকে ১০ হাজার ছোট-বড় সার্জারি হয়; এর মধ্যে কিছু তো জটিল হয়। কিন্তু ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্টের ফ্যাসিলিটি সব অপারেশন থিয়েটরে থাকলে এসব জটিলতা কমানো যেত,' তিনি আরও বলেন।

অপারেশনের সময় বা পরে ব্যবহার করা হয় জি-পেথিডিন ইনজেকশন। নকল জি-পেথিডিন তৈরি করে বাজারজাত করার একটি চক্রের কয়েকজনকে সম্প্রতি আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

ঘুমের ইনজেকশন জি-ডায়াজিপামকে ঘরোয়াভাবে রূপান্তর করে চেতনানাশক জি-পেথিডিন ইনজেকশন বানিয়ে দীর্ঘ সাত–আট বছর ধরে বাজারজাত করে আসছিল চক্রটি। এ সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অ্যানেসথেসিওলজিস্টের পরামর্শের গুরুত্ব

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. শোমান অনিরুদ্ধ রোগীর সচেতনতার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

'যেকোনো সার্জারির সময় রোগী সাধারণত সার্জনকে চেনেন, কিন্তু অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে চেনেন না। এখন অপারেশনের আগে খোঁজ নিতে হবে অ্যানেসথেসিওলজিস্টে কে, তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কি না। অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। দক্ষ অ্যানেসথেসিওলজিস্টে অপারেশনের সময় কোনো জটিলতা হলেও তা ঠিকমতো সামলে নিতে পারেন,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দুই হাজার ৪০০ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এ পেশায় যুক্ত আছেন যা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।

অধ্যাপক ডা. কাওসার সরদার অস্ত্রোপচারের আগে বিস্তৃত পরিসরে রোগীর মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

'অপারেশনের আগে হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুসে কোনো রোগ আছে কি না তা ঠিকমতো যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো অ্যানেসথেসিওলজিস্ট দিয়ে পরীক্ষা করা হয় না আমাদের দেশে। একজন সার্জন যেমন রোগীর মূল্যায়ন করেন এবং অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন, তেমনি রোগীর যেকোনো সম্ভাব্য স্বাস্থ্য জটিলতা সম্পর্কে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত,' বলেন তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.