ঢাকা উত্তরের বাজার মনিটরিং: আদৌ কিছু যায় আসে?

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
19 March, 2024, 10:45 am
Last modified: 19 March, 2024, 12:16 pm
নগর কর্মকর্তারা জানান, “দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর সেই তালিকা আমাদেরকে পাঠায়নি। আসলে নতুন দাম নিয়ে সিটি কর্পোরেশনে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসে নাই। যে কারণে আমরা আগের তালিকা ধরে কাজ করছি।”

ঘড়ির কাটায় সাড়ে এগারটা ছুঁই ছুঁই, ২৫-৩০ জনের একটি দল বনানী কাঁচাবাজারের ভেতর প্রবেশ করছিলেন। পাঁচ-ছয়টা টিভি ক্যামেরা, কয়েকজন ইউটিউবার, পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক, পুলিশ, আনসার, একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এই দল। 

দলের নেতৃত্বে ছিলেন উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুলকার নায়ন। বাজারে ঢুকেই হাতের বামে একটি মুরগির দোকানে সোনালী মুরগির দাম ৩৩০ টাকা লেখা দেখে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্পোরেশনের অন্য কর্মকর্তারা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "৩২০ টাকার মুরগি কেন ৩৩০ টাকা লেখা হলো? 

এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট চোখ বড় বড় করে নির্দেশ দিলেন, "এখন থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি করবা, এই দামে জরিমানা করবোনা। বেশি নিলে কিন্তু জরিমানা করে দেব।" দোকানিও সঙ্গে সঙ্গে দাম পরিবর্তন করে ৩২০ টাকা করলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, "সরকারি মূল্য তালিকার বাইরে কেউ গেলে কাউন্সিলর মোহদয়ের নেতৃত্বে টিম আসবে, আমি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আসবো, ব্যবস্থা নেব। আর কিন্তু ব্যবসা করতে পারবা না।" 

পাঠকের জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো– গত ১৫ মার্চ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতি কেজি সোনালী মুরগির যৌক্তিক সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন ২৬২ টাকা।

এই টিমে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ছিলেন ডিএনসিসির বাজার মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক ও ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম। এই কাউন্সিলর এক ঘণ্টা পরপর দোকানের মূল্য পরীক্ষা করে দেখার ভয় দেখাচ্ছিলেন দোকানিদের।

আরও এক মুরগির দোকানে দাঁড়িয়ে ম্যাজিস্ট্রেট দোকানিকে দেশি বলে কক মুরগি যেন না বেচেন সে বিষয়ে সতর্ক করলেন। 

এবার গেলেন পাশের ডিমের দোকানে। ডিমের দাম জেনে দেশি মুরগির ডিম দেখিয়ে বললেন, "এটা কি আসলেই দেশি না সোনালী মুরগির ডিম?" বিক্রেতা বললেন, "দেশি না হলে জরিমানা দিমু স্যার। আপনাকে এক ডজন দিয়ে দিব? ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য "না" বলে হাঁটা দিলেন।

পাশেই আরেকটি দোকানে ব্রয়লার মুরগির দাম লেখা ২২০ টাকা। দেখে মনে হলো ২৩০ কে মাত্রই নতুন করে ২২০ টাকা লিখেছেন ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবরে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট দেখে বললেন, ২২০ টাকা, ও ঠিক আছে। 

কিন্ত কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত প্রকৃত খুচরা দাম হলো ১৭৫.৩০ টাকা। এই প্রাইস চার্টটাই সিটি কর্পোরেশনের বাজার মনিটরিং এর মূল ভিত্তি হলেও ২২০ টাকাকে কেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন 'ঠিক' বললেন– তা বোধগম্য নয়।

এরপর একটি দোকানে সয়াবিন তেল, ছোলা ও বেসনের দাম জানতে চেয়েই এর পরের লেবুর দোকানে মনোযোগ দিলেন তিনি। বড় একটি লেবু হাতে নিয়ে বললেন, "একটা লেবু ১৫ টাকা বিক্রি করলে মানুষ খাবে কী? গরিবের লেবু কই, সেটা না বেচলে মানুষ খাবে কী?" শেষ পর্যায়ে অবশ্য নির্দেশই দিয়ে দিলেন এটা ১০ টাকা করে বিক্রি করতে। 

অভিযানের এই পর্যায়ে অবশ্য নতুন করে আরও কয়েকটি টিভি ক্যামেরা যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে কিছু উৎসুক দোকানিও। অতি মানুষের ভীড়ে অবশ্য হাঁটাই এখন মুশকিল হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট আরও দুটি সবজির দোকান ঘুরে ৮০ টাকার বেগুণকে 'ঠিক দাম' বলে গরুর মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। 

দোকানে ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস দেখে 'ঠিক আছে' বলে, এই ১৫ মিনিটের অভিযানের ব্যখ্যা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন টিভি ক্যামেরার সামনে। যদিও প্রতি কেজি গরুর মাংসের সরকার নির্ধারিত দর ৬৬৪.৩৯ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। 

এ সময় তিনি বলেন, "সরকার থেকে আমাদেরকে যে মূল্য তালিকা দেওয়া হয় সেটা ধরে আমরা বাজারে বিশেষ করে কৃষি পণ্যের দাম দেখেছি। সেখানে খুব বেশি ব্যত্যয় করতে দেখা যায়নি।…. আমরা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে যদি অতিরিক্ত দাম নেওয়া, মূল্য তালিকা না থাকার মত চিত্র দেখি, তাহলে জরিমানা করি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।"

এবার সাংবাদিকের প্রশ্ন– আপনারা সরকারের কোন প্রাইসটাকে ধরে বাজার মনিটরিং করছেন। 

উত্তরে তিনি বলেন, "প্রতিদিনই কৃষি বিপণন অধিপ্তর থেকে আমরা মূল্য তালিকা পাই, যেটা দিয়ে মনিটরিং করা হয়।" 

এবারে সাংবাদিকদের প্রশ্ন– তাহলে এই তালিকায় অনুযায়ী গরুর মাংস, মুরগির মাংসের দাম আরও কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে বেশি দামে বিক্রি হওয়ার পরও আপনার কাছে কেন দামগুলো ঠিক মনে হলো? 

তিনি উত্তরে বললেন, "সরকার যথেষ্ট গবেষণা করেই দাম নির্ধারণ করছে। কিন্তু নতুন প্রাইসটা ইদানিং দিচ্ছে। এ কারণে দুইটা প্রাইসের মধ্যে সমন্বয় বা গ্যাপটা কমানোর জন্য আমাদের কাজ করতে হচ্ছে এবং কিছুটা সময় দরকার। বাজার মনিটরিং কমিটি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সবাই মিলেই দামটা যৌক্তিক রাখতে কাজ করছি।" এতে একটু সময় লাগবে বলেই এড়িয়ে গেলেন এবং বাজার থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

এবারে দৃশ্যপটে ঢুকলেন আরেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান। তিনি অবশ্য বাজারটিতে ভাই ভাই চিকেন হাউজের ফ্রিজে দেখতে পেলেন কাঁচা- কাটা ও আস্ত মুরগির মাংস, দুধ একই ফ্রিজে রাখা। দোকানির কাছে ফ্রোজেন এসব পণ্য বিক্রির নেই লাইসেন্স। দোকানের মালিক মো. যোবায়ের দোষ স্বীকার করায় তাকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো।

এবারে বাজারের বাইরে এসে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান ও ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম দুজনেই বাজারে কীভাবে মনিটরিং করা হলো, তা বলা শেষ করতে না করতেই সাংবাদিকদের প্রশ্ন– কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ১৫ মার্চ যে ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। বাজারটিতে সবগুলো পণ্যের দামই বেশি। কিন্তু আপনারা কেন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না, তাহলে মনিটরিং নামক এই আইওয়াশের দরকারটাই কী? 

প্রথমে কাউন্সিলর বললেন, তাদের কাছে যে মূল্য তালিকা সে অনুযায়ী বাজার ঠিক আছে। কিন্তু সাংবাদিকরাও নাছোরবান্দা। এবারে কাউন্সিলর তার হাতে থাকা মূল্য তালিকা যাচাই করে দেখলেন সেটা ১৪ তারিখের। বারবার বলতে থাকলেন, "দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর সেই তালিকা আমাদেরকে পাঠায়নি। আসলে নতুন দাম নিয়ে সিটি কর্পোরেশনে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসে নাই। যে কারণে আমরা আগের তালিকা ধরে কাজ করছি।" 

অবস্থা বিবেচনায় এবারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান সাংবাদিকদের বললেন, "দাম নির্ধারণের বিষয়টি আমরা জানি। কিন্তু হয়তো কোনো কারণে এটা আমাদের পর্যায়ে আসতে দেরি হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু সেটা পেলে আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।" 

তিনি অবশ্য এবারে একটু বিচক্ষণতার পরিচয়ও দিলেন। নিজের গলদটা সাংবাদিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, "নতুন তালিকা ধরে অভিযান তো হবেই, আপনারাই তো ব্রিফিং এর জন্য আমাদের ডেকেছেন। এখনও অভিযান শেষ হয়নি।"

অবশেষে মিনিট দশেকের কথার তর্ক শেষে আবারও তারা বাজারে অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্ত আবার পছন্দ হলো না ব্যবসায়ীদের। 

নতুন করে শুরু হলো অভিযান। প্রথমেই বাজার কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আলীর কাছে ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চাইলেন অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে। 

সে বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নানান পরামর্শ দিয়ে যাওয়ার পথে দেখতে পেলেন দোকান ছেড়ে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে দোকানের মালপত্র। এরকম অপরাধে তিনজন দোকানিকে ৫,০০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। 

কিন্তু গরু, মুরগি, সবজি, মুদি দোকানের সামনে দিয়ে গেলেও সেসব দোকানিদের কিছু জিজ্ঞেস করতে দেখা যায়নি। 

এদিকে সাংবাদিকরাও নাছোরবান্দা, ম্যাজিস্ট্রেটের পিছু কোনোভাবেই ছাড়ছেন না। বিপাকে পড়া ম্যাজিস্ট্রেট এবারে বাধ্য হয়েই ভাই ভাই সবজি স্টোরে আলুর দাম ৪০ টাকা হওয়ার অপরাধে ৫,০০০ টাকা জরিমানা করলেন। কারণ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী আলুর দাম ২৯ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। 

এরপর আবার মিডিয়ার সমানে বিশাল অভিযানের বর্ণনা দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের এই টিমটিকে দ্রুত বাজার ত্যাগ করতে দেখা যায়।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.