সবচেয়ে বড় চাল ব্যবসায়ী যখন সবচেয়ে বড় দেউলিয়া হওয়ার পথে

বাংলাদেশ

09 March, 2024, 09:15 am
Last modified: 09 March, 2024, 05:46 pm
২১৭ জন বিবাদি জড়িত এ মামলাটি বিবাদির সংখ্যা এবং মোট অর্থ উভয় দিক থেকেই দেউলিয়া আদালতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা।
ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

অল্প কয়েক বছর আগেও রাজ্জাক নামটি বাংলাদেশের চালের ব্যবসার সমার্থক ছিল। দেশে বেশ দাপটের সঙ্গে চালের ব্যবসা পরিচালনা করেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার চালের ব্যাবসা ছিল তার।

তবে ২০১৪ সালে সরকারের তৈরি শুল্কমুক্ত চাল আমদানি নীতি এবং এরপর ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে তার ব্যাবসা। এখন রাজ্জাকের চাল সাম্রাজ্য অস্তাচলগামী; তিনি ইতোমধ্যে দেউলিয়া হওয়ার জন্য মামলা করেছেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দেউলিয়ার মামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এ মামলাটি।

বিভিন্ন ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির কাছে ২৩৮ কোটি টাকার বেশি ঋণের বোঝায় জর্জরিত রাজ্জাকের বিরুদ্ধে এসব ঋণ পরিশোধের জন্য ৭১টি মামলা করেছেন পাওনাদারেরা।

ছিলেন অটো রাইস মিলের পথিকৃৎ

রাজ্জাকের উদ্যোক্তাযাত্রা শুরু হয় চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত নওগাঁ জেলায়। ১৯৮০-এর দশকে স্বয়ংক্রিয় চালকলের [অটোমেটেড রাইস মিল] বাজার গড়ে উঠলে রাজ্জাক নিজেকে এ শিল্পের একজন অগ্রগামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

২০০৮ সাল নাগাদ তিনি ৫টি বড় অটো রাইস মিলের মালিক হয়ে ওঠেন। এসব মিলে দুই হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার চাল উৎপাদন ও বিক্রয় হতো মিলগুলো থেকে।

রাজ্জাকের সুইস, জাপানি ও চীনা আধুনিক যন্ত্রপাতির মেসার্স রাবেয়া, কফিল এগ্রো, বিসমিল্লাহ, করিম ও কফিল আতব মিলের মোট বার্ষিক উৎপাদন দাঁড়ায় চার হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।

ভাঙনের শুরু

২০১৪ সালে সরকার ভারত থেকে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর থেকে রাজ্জাকের সাফল্য ম্লান হতে শুরু করে।

'এ নীতির ফলে সরকারি গুদামগুলো সস্তা ভারতীয় চাল দিয়ে ভরে যায়। অনেক নতুন ব্যবসায়ী বাজারে প্রবেশ করেন,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন রাজ্জাক। তিনি তুলনামূলক সস্তা আমদানিকৃত চালের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উঠতে পারেননি। গুদাম থেকে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন চাল লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে ঋণ পরিশোধ এবং ব্যাবসার খরচ মেটানোর ওপর আরও চাপ পড়ে।

'এদিকে একটি ব্যাংকে আমার একটি চালকলের জন্য ৪৭ কোটি টাকার ঋণ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু ব্যবসার অবস্থা খারাপ দেখে তারা মাত্র ৩২ কোটি টাকা ছেড়েছিল। বাকি ১৫ কোটি টাকা আর দেয়নি,' বলেন রাজ্জাক।

এরপর সিসি [ক্যাশ ক্রেডিট] ঋণ নিয়ে এবং এমনকি জমি বিক্রি করার চেষ্টা করেও রাজ্জাক তার ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

'২০১৮ সালে ২টি অটো রাইস মিলের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হই। ৩টি মিলে কোনোরকম কার্যক্রম পরিচালনা করি। পর্যাপ্ত ধান সংগ্রহ করতে পারতাম না। ফলে আগের মতো চালও উৎপাদন হতো না,' বলেন এ ব্যবসায়ী।

তার একসময়ের সুপরিচিত ব্র্যান্ড রাজ্জাক মিনিকেট, রাজ্জাক পাইজাম, রাজ্জাক আতপ চাল এবং রাজ্জাক নাজিরশাইল বাজার হারাতে শুরু করে। 'বাকি মিলগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের মজুরি, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, বিদ্যুৎ বিল এবং ঋণের কিস্তি জমা হতে থাকে,' তিনি বলেন।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি রাজ্জাকের ব্যাবসায় চূড়ান্ত ধাক্কা দেয়। 'সবগুলো মিলের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হই। সরকার বা কারও কাছ থেকে কোনোরকম সহযোগিতা না পাওয়ায় আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ি,' রাজ্জাক বলেন।

'আমার অনেকগুলো জমি, বেশ কয়েকটি বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর কাছে যে পরিমাণ সম্পত্তি বন্ধক আছে, সেগুলো বিক্রির সুযোগ নেই। আর আমার সকল সম্পত্তি বিক্রি করেও ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যক্তির পাওনা প্রায় ২৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ সম্ভব নয়। ফলে বাধ্য হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য মামলা করেছি,' টিবিএসকে বলেন তিনি।

২৩৯ কোটি টাকা দেনা, ৭১টি মামলা

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২০২২ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের ৩০ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৩২ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করে আকিজ গ্রুপ তার দুটি মিল — রাবেয়া ও কফিল এগ্রো কিনে নেয়। তিনি বড় লোকসানে মিলগুলো বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেন।

মিল বিক্রি হলেও রাজ্জাকের ঋণের বোঝা কমেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তার ২৩৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকারও বেশি বকেয়া রয়েছে।

ছয়টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান রাজ্জাকের কাছ থেকে মোট ২২২ কোটি টাকার ঋণ দাবি করেছে। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে সর্বোচ্চ ঋণ ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তারপরেই ৬৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা দাবি নিয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সাউথইস্ট ব্যাংক, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালও আট কোটি সাত লাখ টাকা থেকে ৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দাবি করেছে।

এছাড়াও ২১১ জন চাল ব্যবসায়ী এবং খুচরা বিক্রেতাও তাদের বকেয়া ফেরত চাইছেন। এ ঋণের পরিমাণ মোট ১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ঢাকা ও বগুড়াসহ বিভিন্ন আদালতে ৭১টি মামলা করেছে ঋণ দাবি করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৫৯টি দেওয়ানি মামলা এবং চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত ১২টি ফৌজদারি মামলা। ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট একাই ৩১টি মামলা করেছে।

ঋণ পরিশোধে অপারগতার কথা উল্লেখ করে রাজ্জাক তার সম্পদ বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি দাবি করে গত বছরের আগস্টে ঢাকার আদালতে দেউলিয়াত্বের মামলা করেন।

ঢাকার দেউলিয়া আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২১৭ জন বিবাদি জড়িত এ মামলাটি বিবাদির সংখ্যা এবং মোট অর্থ উভয় দিক থেকেই দেউলিয়া আদালতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা।

আদালতের নথি থেকে জানা যায়, রাজ্জাকের ২১১ জন ব্যক্তিগত পাওনাদার রয়েছেন যারা তার কাছে ২০৫ টাকা থেকে শুরু করে এক কোটি টাকারও বেশি পান।

আবদুর রাজ্জাকের আর্থিক সঙ্গতি এতটাই করুণ হয়েছে যে, তিনি তার দেউলিয়াত্বের আবেদনে সারোয়ার হোসেন নামক একজন খুচরা চাল বিক্রেতাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রাজ্জাকের কাছে নওগাঁর স্থানীয় এই দোকানদারের পাওনা মাত্র ২০৫ টাকা।

সারোয়ার জানান, ২০১৭ সালে একবার চাল কেনার সময় এ টাকা বাকি পড়ে। 'আমি রাজ্জাকের কাছ থেকে মাসিকভিত্তিতে প্রায় ৭০ মণ চাল পাইকারি ক্রয় করতাম। কিন্তু এখন উনি প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন। আমার এ টাকা নিয়ে কোনো দাবি নেই,' টিবিএসকে বলেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পাওনাদার হলেন মহাদেবপুরের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার খান। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'কয়েক টন চাল সরবারহ করতে এক কোটি ৩১ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু তিনি আর পরিশোধ করেননি। অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। এখন তার বিরুদ্ধে মামলা করব। দেউলিয়া মামলা করার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে রাজ্জাকের।'

কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব-উল আলম বলেন, সম্ভাব্য গোপনীয়তা বা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনা মোকাবিলার জন্য এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পদের তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজ্জাকের মামলার অবস্থা

দেউলিয়াত্বের আবেদনে নাম থাকা ২১৭ বিবাদির সবার উদ্দেশে সমন জারি করা হলেও কেবল ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়া দিয়েছে। অবশিষ্ট ব্যক্তিদের সাড়ার অভাবে বিচার শুরুতে বিলম্ব দেখা দিচ্ছে।

আইন পেশাজীবীরা বলছেন, সমনের জবাবের ওপর শুনানির পর আদালত যদি রাজ্জাকের আবেদনের বৈধ কারণ খুঁজে পান, তাহলে বিচার শুরুর আগে তার সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ করা হবে। যেহেতু সমনের কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি, তাই রিসিভার নিয়োগ বা বিচার কবে শুরু হবে তা বলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে দেউলিয়া মামলা

দেশে বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য ১৩৮টি মামলা করেছে। ব্যাংকের করা মামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য ৯৩ জন ব্যক্তি মামলা করেছেন, যেখানে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা জড়িত।

নওগাঁর ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের দায়ের করা দেউলিয়া ঘোষণার আবেদনটি অর্থ ও বিবাদির হিসেবে সবচেয়ে বড় মামলা। ২০২০ সালে হালিমা টেক্সটাইলের ছয় ব্যক্তির কাছ থেকে পূবালী ব্যাংকের ৯৬ লাখ টাকা এবং ২০১৪ সালে বকেয়া ১৯০ কোটি টাকার ঋণের জন্য মোজাম্মেল হোসেনের দেউলিয়া দাবির মতো অতীতের বড় বড় মামলাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে এটি।

১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মিজানুর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশে প্রথম ব্যক্তি যাকে আদালত দেউলিয়া ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৮০-এর দশকে পাইওনিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সুদ-আসলে ৩১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার পর আর্থিক সমস্যার মুখে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যান।

আদালত তাকে ১৯৯৯ সালে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সালে দায়ের করা এ মামলাটি দেউলিয়া আইন ১৯৯৭-এর অধীনে দেউলিয়া হওয়ার আবেদনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

এ আইনে দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন ব্যক্তি এবং ব্যাবসাকে দেউলিয়া ঘোষণা এবং ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আইনি পথ সরবরাহ করা হয়।

আদালতের অনুমোদনের পরে বাদির সম্পদ ঋণ মেটানোর জন্য বিক্রি করা হয়। এরপর বাদিকে ঋণমুক্তি দেওয়া হয়। এছাড়া ব্যাংকের মতো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে এ আইনের অধীনে।

ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে দেউলিয়া আইনের মূল নীতিসমূহের মধ্যে মিল থাকলেও দেউলিয়া হওয়ার প্রক্রিয়া চলাকালীন সম্পদ গোপন করার শাস্তির মাত্রা আলাদা।

ভারতীয় আইনে মামলায় সম্পদের তথ্য গোপনের জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন আইনে কারাদণ্ডের পাশাপাশি ব্যক্তির আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

আবদুর রাজ্জাকের দেউলিয়া হওয়ার আবেদন আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে তিনি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যোগ্যতা হারাবেন, কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে ও আকাশপথে ভ্রমণ করতে পারবেন না এবং বিদেশ ভ্রমণ করতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.