‘নারীরা চাইলেই দেশে তৈরি জামদানি-বেনারসি ব্যবসার সুদিন ফেরাতে পারে’

বাংলাদেশ

05 March, 2024, 10:50 am
Last modified: 05 March, 2024, 11:59 am
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে এই উদ্যোক্তা জানান, “আমাদের আসলে শিল্পটাকে রক্ষা করতে হবে। এর জন্য যেসব তাঁতিরা পেছনে থেকে পণ্যগুলো তৈরি করেন, তাদেরকে প্রমোট করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে।” 

স্থানীয়ভাবে হাতে তৈরি জামদানি, বেনারসি, সিল্ক, মসলিন কাপড়ের বাজার ছোট হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে এসব তৈরির কারিগররাও এ খাত থেকে সরে যাচ্ছেন। বিদেশ থেকে আসা কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে না পেরে স্থানীয় এই ঐতিহ্য মলিন হয়ে যাচ্ছে। তবে বিদেশি শাড়ির বদলে নারীরা যদি স্থানীয় পণ্যগুলো কিনতে শুরু করে, তাহলে ব্যবসার সুদিন আবারও ফিরতে পারে বলে মনে করেন 'দ্য মসলিন'-এর ফাউন্ডার ডিরেক্টর ও সিইও তাসনুভা ইসলাম। 

এই উদ্যোক্তা বাংলাদেশের তাঁত এবং হস্তশিল্প (হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যান্ড ক্রাফট) ঐতিহ্য ধরে রাখতে 'দ্য মসলিন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। যেখানে পাওয়া যায় জামদানি, বেনারসি, সিল্ক, মসলিনসহ ঐহিত্যবাহী সব পণ্য। টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে এই উদ্যোক্তা জানান, "আমাদের আসলে শিল্পটাকে রক্ষা করতে হবে। এর জন্য যেসব তাঁতিরা পেছনে থেকে পণ্যগুলো তৈরি করেন, তাদেরকে প্রমোট করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে।" 

তিনি বলেন, "এর চেয়েও বড় বিষয়-আমাদের নারীদের ব্যাপক একটি ভূমিকা রয়েছে। বিদেশি শাড়ি কেনার যে ঝোঁক, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে যদি দেশীয় এসব পোশাকের ব্যবহার শুরু হয়– সেটা কিন্তু এ শিল্পের চেহারাই পরিবর্তন করে দেবে। কারণ কেনাকাটায় নারীদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।"

একসময় হ্যান্ডলুম করার জন্য ১,০০০-১,২০০ তাঁতি ছিল; কমতে কমতে অবস্থা এ পর্যায়ে এসেছে যে এখন ৫০ জন তাঁতিও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রজন্ম তৈরির জন্য বর্তমানে যারা আছেন এবং যারা উৎসাহী তাদেরকে আরও দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিকল্প নেই বলে জানান তাসনুভা ইসলাম।

এ উদ্যোক্তা জানান নব্বইয়ের দশকে মানুষের কাছে অপশন (বিকল্প) কম ছিল। তখন এর জনপ্রিয়তা ছিল। তখন বিকল্প মানেই ছিল সিল্ক, বেনারসি, ফুল কটন। এখন ফুল কটন, পলেস্টার, নাইলন, ফুল সিল্কের মতো অনেক অপশন রয়েছে। তবে দামের কারণে অনেকে কিনতে চান না। মজুরি থেকে শুরু করে সব খরচই বেড়েছে। 

এ ব্যাপারে তিনি অবশ্য দায়ী করলেন মধ্যসত্তভোগীদের। যারা কিনা নামমাত্র মূল্যে ঐতিহ্যবাহী এসব পণ্য কিনে বাজারে অনেক চড়া দামে বিক্রি করেন। অথচ তাঁতিরা না এর সুফল ভোগ করেন, না পান মূল্যায়ন। এই সুযোগে ট্যাক্স দিয়ে, ট্যাক্স ছাড়া, লাগেজের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্য এসে বাজার সয়লাভ। যেগুলো সবাই লুফে নিচ্ছে। অথচ এই মানসিকতার পরিবর্তন চান দ্য মসলিনের প্রতিষ্ঠাতা তাসনুভা ইসলাম। 

তিনি বলেন, "আমরা সরকারের কাছে একটা জায়গা চাই, অনুমতি চাই। যাতে করে বিশেষভাবে এই হ্যান্ডলুম তৈরির তুলাটা আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারি। আর তাঁতিদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে করে তারা আরও বেশি দক্ষ এবং উন্নত পণ্য তৈরি করতে পারে। 

তাসনুভা ইসলাম জানান, "আমাদের দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যের সঙ্গে ডিজাইনারের নাম যুক্ত থাকে। কিন্তু ডিজাইনার তো শুধু ভাবনাটা শেয়ার করেছেন, পণ্যটা তো তৈরি করলো তাঁতি। তার স্বীকৃতি কই? তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাকে প্রমোট করতে হবে।" 

দ্য মসলিন নিজে ব্র্যান্ড হিসেবে তাঁতিদেরকে উৎসাহ যোগানোর কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্ল্যাটফরমে তাঁতিরা দুইভাবে পণ্য সরবরাহ করে। কেউ কেউ তার চাওয়া অনুযায়ী পণ্যের দাম নিতে পারে, আবার অনেকে আছেন যারা চান বাজার মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে। তারা এখানে ২০ শতাংশ কমিশন প্রদান করে। অর্থাৎ, তাঁতি বা কারিগর নিজেরাই এর দামটা ঠিক করেন। 

তাসনুভা ইসলাম বলেন, "আমরা তাঁতিদের বাঁচিয়ে রাখতে অনেকটা সিএসআর করছি। আমার প্ল্যাটফরমটাকে তাঁতিদের ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছি। এতে করে দুটো সুবিধা একসঙ্গে হচ্ছে। তাঁতিরা ভালো দাম পাচ্ছে এবং মধ্যসত্তভোগী না থাকায় বাজারের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে ক্রেতাও পণ্য পাচ্ছে।" 

এ উদ্যোক্তা ব্যক্তিজীবনে পড়াশোনা শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তবে দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যাওয়ায় পেশা ছাড়তে হয়। ফটোগ্রাফি ও ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের প্রতি আলাদা ঝোঁক ছিল তার। 

সেখান থেকেই হ্যাল্ডলুম ও হ্যান্ডিক্র্যাফটের একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলেন এই উদ্যোক্তা, যার ভাবনাটা মূলত কোভিড-১৯ এর সময়ে আসে। উদ্যোক্তা তাসনুভা ইসলাম বলেন, "আমাদের পণ্যগুলো সবই এত সুন্দর, তবে এগুলোর যথাযথ প্রচার নেই। ফাইভস্টার হোটেলগুলো এগুলো করেই না। একটা ছোট্ট জায়গায় সুভেনিয়র শপ থাকে, তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। অথচ বিদেশিদের কাছে আমরা দারুনভাবে ব্রন্ডিং করতে পারি।"  

তিনি বলেন, "আমরা চাই লোকাল ও বিদেশিরা এসে দেখুক আমাদের জিনিসগুলো আসলে কতটা সুন্দর। এই প্রচারণাটা আমরা করছি, আমাদের প্রডাক্টগুলো কতটা ইউনিক সেটা আমরা বলছি। এটা শুধু আমরা না, বেসরকারি খাত এবং সরকার মিলে করতে হবে। জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মসলিনকে। এখন পণ্যটাই হারিয়ে গেলে কিন্তু জিআইয়ের যে সুবিধা সেটা আমরা নিতে পারবো না।"

ক্রেতাদের মানসিকতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একটা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে, একটা জিনিস একবার পরলে আর পরবো না। তাহলে একটা জিনিস কেন এত দাম দিয়ে কিনবো এই ধারণাটাও রয়েছে। তবে আসল চিত্র ভিন্ন, অনেক ব্র্যান্ডের জিনিসের চেয়ে আমাদের পণ্যগুলোর তুলনামূলক দাম কিন্তু কম। আবার বিদেশি জিনিস ব্যবহার করতে হবে, এটাও কিন্তু একটা ঝোঁক। অথচ আমাদের জিনিসগুলো ভালো, ডিজাইন বা বৈচিত্র্যে অনন্য। বাংলাদেশি ডিজাইনারদেরও এই জিনিসগুলো তুলে ধরতে হবে।" 

তিনি বলেন, "এ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আরও বেশি অ্যাওয়ারনেস তৈরির কাজ করতে হবে। পণ্যের ব্র্যান্ডিং করতে হবে।" 

শুধু দেশীয় পণ্য নিয়ে দ্য মসলিনের যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। সরাসরি তাঁতিদের থেকে পণ্য নিয়ে শোরুমে রাখেন তারা। হারিয়ে যাওয়া সেই মসলিনের ছোঁয়া, দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া রয়েছে দ্য মসলিনের পণ্যে। শাড়ি, জুতা, গয়না, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যায় এখানে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.