ছেলের জন্য ডিম ভেজে অপেক্ষায় ছিলেন মা, সীমান্তের ওপার থেকে আসা মর্টার কেড়ে নিল প্রাণ

বাংলাদেশ

07 February, 2024, 12:55 pm
Last modified: 07 February, 2024, 04:25 pm
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ছোঁড়া মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হন ঘুমধুম সীমান্তের জলপাইতলীর বাসিন্দা হোসনে আরা

সোমবার দুপুরে ছেলে মো. ইব্রাহিমের (২১) জন্য ডিম ভেজেছিলেন মা হোসনে আরা। ছোট বেলা থেকে ছেলে ডিম ছাড়া ভাত খান না। ছেলে এক বন্ধু ধার দেবে বলে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছেন। বাসা থেকে বের হয়ে সড়কে নামতে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ছোঁড়া মর্টার শেলের পড়ে বাড়ির রান্না ঘরে। সেখানে থাকা ইব্রাহিমের মা হোসনে আরার (৫৫) কোমড়ে মর্টার পড়ে গুরুতর আহত হন।

ঘটনাস্থলে বাড়িতে কাজ করা শ্রমিক রোহিঙ্গা বৃদ্ধ নবী হোসাইন (৬৫) মারা যান। আর হাসপাতালে নিতে নিতে হোসনে আরাও মারা যান। 

বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের হোসনে আরার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা এখনো বিলাপ করছেন। ঘরের সামনে একটি চৌকিতে বসে বিলাপ করছিলেন নিহত হোসনে আরার ছোট ছেলে ইব্রাহিম। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে মায়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইব্রাহিম। তিনি বলেন, "আমি ছোট বেলা থেকে মাছ-মাংস তেমন খাই না। প্রত্যেক বেলায় ডিম খাই। আমি যোহরের নামাজ পড়ে বাসায় এসে দেখি মা রান্না ঘরে কাজ করছিলেন। আমার জন্য ডিম ভেজেছেন। নামাজ পড়ে এসে মাকে নামাজ পড়তে বলায় মা বললেন, 'আমার ছেলে মৌলভি হয়েছে'। তখন তিনি ডিম ভেজেছেন। খেতে বলেন। আমি জবাবে জানাই, 'একজনকে টাকা ধার দিয়ে বাবাকে নিয়ে এসে ভাত খাবো।'"

তিনি আরো বলেন, "বাসা বের হওয়ার আগে মাকে নামাজ পড়তে বলায় তিনি খুশী হয়ে আমার কপালে চুমু খেয়েছিলেন। সড়কে নামতেই বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি। এরপর বাসায় গিয়ে দেখি রান্না ঘরে ধোয়া। মায়ের কোমড়ে মর্টার শেল পড়েছে। আমার মা শেষ হয়ে গেলেন।"

নিহত রোহিঙ্গা বৃদ্ধ নবী হোসাইন এই বাড়িতে কাজ করেন ছয় বছরের বেশি সময় ধরে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খাবার তিনি খেতে পারেন না। এজন্য এখানে কাজ নিয়েছেন। বাড়িতে যা রান্না হয় তিনি তা-ই খান। হোসনে আরাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন নবী হোসাইন।

সোমবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিস্ফোরণের সময় রান্নাঘরে তাকে ভাত খেতে দিচ্ছিলেন হোসনে আরা। মর্টার শেল পড়লে এই রোহিঙ্গা বৃদ্ধ ঘটনাস্থলে মারা যান।

নিহত হোসনে আরার বাড়ির রান্নাঘরেই মর্টার শেলটি আঘাত হানে। ছবি: জোবায়ের চৌধুরী

জলপাইতলীর হোসনে আরার বাড়ির সামনে নাস্তার দোকান করেন স্বামী বাদশা মিয়া (৬৫)। এই দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে শফিউল আলম (৩১) টমটম চালাক। তার চার সন্তান আছে। ছোট ছেলে ইব্রাহিম দোকান পরিচালনায় সহযোগিতা করেন। তিনি মাত্র তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন। 

বড় ছেলে শফিউল আলম টিবিএসকে বলেন, "আমার মা অনেক পরিশ্রমী ছিলেন। একটি ছাগল, দুটি গরু, অর্ধশতাধিক মুরগি পালতেন। এছাড়া আড়াই খানি জমিতে মরিচ ও ধান চাষ করেছেন। কবুতর পালার শখ ছিল। ১১টি কবুতর আছে তার। সামনের কোরবানির ঈদের (ইদুল ফিতর) পর নতুন করে ঘর বাঁধার কথা ছিল। কিন্তু তিনি চলে গেলেন।"

মঙ্গলবার হোসনে আরার দাফন সম্পন্ন হয়। এরপর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা বড় ছেলে শফিউলের শ্বশুর বাড়ি উখিয়ায় অবস্থান করছেন। গোলাগুলি কিছুটা কমায় বুধবার সকাল তারা বাড়ি ফিরেন। বাড়ি ফিরেই মায়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে শোকে বিভোর হয়ে পড়েন। 

মাথা আচরানোর পর চিরুনিতে থাকা চুলগুলো বাড়িটির রান্নাঘরের বাইরের অংশের বাঁশের খুঁটিতে জমিয়ে রাখার অভ্যাস ছিল হোসনে আরার। ছোট ছেলে ইব্রাহিম সেখান থেকে আধপাকা চুল হাতে নিয়ে কাঁদতে থাকেন।

রান্নাঘরের স্টিলের গ্লাসে বানানো ওইদিনের মরিচের ভর্তাও পড়ে আছে। সেগুলো দেখিয়ে ইব্রাহিম বিলাপ করতে করতে বলেন, "আমার বাবার মরিচ ভর্তা প্রিয় ছিল। মা সেদিন মরিচ ভর্তা ও রাইস কুকারে ভাত রান্না করেছিলেন। সব আগের মতো রয়ে গেছে। শুধু আমার মা নেই।"

তিনি আরো বলেন, "বৃহস্পতিবার মায়ের জন্য শাড়ি কিনে এনেছিলাম। মা অনেক খুশী হয়েছিলেন। এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মা আর ওই শাড়ি পরেননি।"

মায়ের শেষ স্মৃতি ধূসর চুলের গোছা আঁকড়ে ধরে আছে ইব্রাহিম। ছবি: জোবায়ের চৌধুরী

গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক গুলিবর্ষণ, মর্টার শেলিং ও বিস্ফোরণ অব্যাহত থাকায় সীমান্তের কাছে বসবাসকারী বাংলাদেশি বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে গত রাত পর্যন্ত প্রায় ১৮০টি পরিবার ঘুমধুম ইউনিয়ন ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিনের তথ্যমতে আরও ২৪০টি পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে।

গত কয়েক দিনে বর্ডার গার্ড পুলিশের ২২২ সদস্য, দুই সেনা কর্মকর্তা, চারজন সিআইডি সদস্য, পাঁচজন পুলিশ সদস্য, নয়জন বিশেষ শাখার কর্মকর্তা, ২০ জন অভিবাসন কর্মকর্তা এবং দুজন বেসামরিক নাগরিকসহ ৩২৭ জন।

[বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়ন থেকে জানিয়েছেন জোবায়ের চৌধুরী]

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.