উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ক্যানসার রোগী, আমরা কি প্রস্তুত?

বাংলাদেশ

04 February, 2024, 11:40 am
Last modified: 04 February, 2024, 12:15 pm

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ক্যানসারজনিত মৃত্যু ৮ শতাংশ এবং ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়েছে। ২০৫০ সালে দেশে ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। 

ক্যানসারের রোগী বাড়লেও দেশে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও ক্যানসার সুবিধা এখনও পর্যাপ্ত নয়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যমান ক্যানসারের সুযোগ-সুবিধা অপর্যাপ্ত। এই ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় ক্যানসার প্রতিরোধ, প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং উন্নত ফ্যাসিলিটি স্থাপন প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির (বিসিএস) সভাপতি অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশে ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টর বেড়েছে। পাশাপাশি এখন অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধার জন্য আগের তুলনায় দ্রুত ও নির্ভূলভাবে রোগ ডিটেকশন বেশি হচ্ছে। সে কারণে রোগী বেড়েছে। জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন, স্থূলতা বেড়ে যাওয়া, ধূমপান, পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যক্রম না করা, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া, ফাস্ট ফুড-জাংক ফুডের ওপর র্নির্ভলশীলতা বাড়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ক্যানসার রোগী বেড়ে যাচ্ছে।' 

'আমাদের গড় আয়ু যেহেতু বাড়ছে, কাজেই স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন না করলে ভবিষ্যতে ক্যানসার রোগী আরও বাড়বে,' বলেন তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এ বছরে দিবসটির থিম হচ্ছে, 'ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ'।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছে।

গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরির ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১.৫৬ লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়, আর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১.০৮ লাখ মানুষ।

ক্যানসার চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে ক্যানসার রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা সুবিধা এখন আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। এখন পিইটি-সিটি স্ক্যান, লাইনাক মেশিনসহ অত্যাধুনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিভিন্ন ক্যানসার সেন্টারে আছে। ব্যোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টসহ বিভিন্ন চিকিৎসাও দেশে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এখন দেশেই ক্যানসারের অনেক ওষুধ তৈরি হচ্ছে, যার ফলে খরচ কিছুটা কমেছে।

১০-১৫ বছর আগে দেশে পিইটি-সিটি স্ক্যান মেশিন ছিল না। এখন পিইটি-সিটিসহ অত্যাধুনিক অনেক যন্ত্রপাতি আছে। তবে ১৮ কোটি মানুষের জন্য তা অপ্রতুল বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক। 

দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। এখানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার খরচ বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু এ হাসপাতালের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট, তাই চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র রোগীরা।

বর্তমানে এনআইসিআরএইচের রেডিওথেরাপির ছয়টি মেশিনের মধ্যে চারটি পুরোপুরি নষ্ট। বাকি দুটিও মাঝে মাঝে নষ্ট হয়ে যায়। এমআরআই, সিটিস্ক্যান মেশিনও নষ্ট। এমনকি এক্সরে মেশিনও নেই হাসপাতালটিতে। যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় এখানে বায়োপসিসহ ক্যানসার নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পরীক্ষা করা যায় না। 

জানতে চাইলে এনআইসিআরএইচের পরিচালক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক বলেন, 'বিকল যন্ত্রপাতি ঠিক করার চেষ্টা চলছে। দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন অধিগ্রহণ করা হয়েছে, আরও বাড়তি দুটি স্বাস্থ্য মেশিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংগ্রহ করা হবে।'

চিকিৎসকেরা বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে কিছু কিছু ক্যানসারে ৬-৮ মাসের চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তারপর ৫ বছর ধরে ফলোআপে থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের দরিদ্র রোগীদের সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্নয়ের পর একেকটা রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির তারিখ পেতে পেতেই ৫-৬ মাস পেরিয়ে যায়।

শরীরে কোনো ক্যানসার আছে কি না, বা কোথায় কোথায় ক্যানসার আছে, কিংবা কী পরিমাণ জায়গাজুড়ে ক্যানসার আছে তা জানার জন্য পিইটি-সিটি স্ক্যান টেস্ট জরুরি। দেশে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠানে পিইটি-সিটি স্ক্যান হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এ টেস্টের খরচ অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ টেস্টের খরচ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় খরচ কম হওয়ায় সেখানে এ টেস্ট করাতে একজন রোগীকে ২ থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়।

চিকিৎসার খরচ

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এই খরচ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধপত্র কিনতেই।

ভারতের ক্যানসার কেয়ার ওয়েবসাইট ক্যানসাররাউন্ডস-এর তথ্য অনুসারে, ভারতে ক্যানসার চিকিৎসার গড় ব্যয় ২ লাখ ৫০ হাজার রুপি থেকে ২০ লাখ রুপি। 

গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তুকি দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কম। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে ২০ গুণ বেশি খরচ হয়। তবে দরিদ্র রোগীদের ক্যানসার চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালের অবকাঠামো, যন্ত্রপাতির আরও উন্নতি প্রয়োজন।

''সরকার সারা দেশে ৮টি বিভাগীয় শহরে ক্যানসার সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। অবকাঠামো নির্ণয় শেষ, সেই সেন্টারগুলো আগামী ২ বছরের মধ্যে সেবা দেবে। তখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করলেই হবে না, ক্যানসার প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিতে হবে,' বলেন তিনি।

চাহিদা থাকলেও ক্যানসার হাসপাতালে বেসরকারি বিনিয়োগ কম কেন?

ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ১৭০টি সেন্টার প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এমন সেন্টার আছে মাত্র ৩৩টি। আবার সব সেন্টারে ক্যানসারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয় না।

দেশে ক্যানসার রোগী বাড়লেও সেই তুলনায় ক্যানসার সেন্টার কেন কম, জানতে চাইলে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চেয়ারম্যান ড. এম এ শামীম টিবিএসকে বলেন, জেনারেল হাসপাতালের তুলনায় ক্যানসার হাসপাতালের খরচ দুই থেকে তিন গুণ বেশি লাগে। 

'একটা পিইটি-সিটি স্ক্যান মেশিনের দাম ১৫-২০ কোটি টাকা, রেডিওথেরাপির জন্য যে লাইনাক মেশিনের প্রয়োজন হয়, তার একেকটি মেশিনের দাম ৩০-৪০ কোটি টাকা। এছাড়া টিউমার বোর্ডসহ বিভিন্ন চিকিৎসার উচ্চ বেতন দিয়ে জনবল রাখার প্রয়োজন হয়। বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণ খরচ বেশি,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার খরচ ভারতের তুলনায় বেশি নয় দাবি করে তিনি বলেন, 'আস্থার সংকটের কারণে মানুষ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। আগে কার্ডিয়াক চিকিৎসায় মানুষের আস্থা ছিল না। কারও বুকে ব্যথা হলেই ভারতে যেত। এখন কিন্তু কার্ডিয়াক চিকিৎসা মানুষ দেশেই করে, কারণ সেই আস্থাটা ফিরেছে। মানুষ মনে করে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সেবা নেই, তাই তারা ভারতে যাচ্ছে। কিন্তু যখন দেশেই বেশি বেশি রোগী সুস্থ হবে, তখন মানুষের আস্থা ফিরবে। আমরা আশা করছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মানুষের আস্থা বাড়বে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.