অনেক খোঁজার পর অবশেষে সন্ধান মিলল শিকড়ের

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
27 January, 2024, 04:20 pm
Last modified: 27 January, 2024, 04:34 pm
তাসলিমা কনাকে জানায়, তাদের মা নাসিমাকে দত্তক দিতে চাননি। তাদের বাবার তিনজন স্ত্রী ছিলেন। নাসিমার মা তখন অসুস্থ থাকায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তখন তাদের আরেক মা নাসিমাকে বাড়ির কাছেই একটি ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে আসার জন্য তাদের বাবাকে রাজি করিয়েছিল।

কনা ভেরহুল। বহু বছর আগে অনাথ শিশু হিসেবে তাকে নেদারল্যান্ডসে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। সাত বছর আগে তিনি নিজের শিকড়ের সঙ্গে মিলিত হন। তার স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এ ব্যবস্থা করেছিল ডাচ সরকার।

কনার বেড়ে ওঠা নেদারল্যান্ডসে। তার মতো আরও বহু ব্যক্তি রয়েছেন যাদের শিশুকালে নেদারল্যান্ডসে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কনা এমন ব্যক্তিদের নিয়ে শাপলা কমিউনিটি নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর উদ্দেশ্য দত্তক ব্যক্তির স্বজনদের খুঁজে পেতে সহায়তা করা।

সংস্থাটি বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া শত শত ব্যক্তি যারা নেদারল্যান্ডসে বেড়ে উঠেছেন, তাদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে দাঁড় করিয়েছে।

এ কাজ করতে গিয়ে কনা বাংলাদেশের বহু অভিভাবকের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছেন। তাদের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে গল্প শুনেছেন। অনেক অভিভাবকই দাবি করেছে যে তাদের সম্মতি ছাড়াই তাদের সন্তানদের বিদেশে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।

উল্লেখ্য, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বহু শিশুকে বিদেশে দত্তক নেওয়ার ঐতিহাসিক অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানের পর বাংলাদেশে পুলিশ ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে শিশু দত্তকের ঘটনার তদন্ত শুরু করে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব শিশুকে একটি 'বোর্ডিং স্কুল স্ক্যাম' এর নাম করে তাদের মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই স্কুলটিতে ক্ষতিগ্রস্ত বা অরক্ষিত পরিবারগুলোকে তাদের শিশু সন্তানদের আশ্রয়ের দেওয়া হয় বলে জানানো হয়েছিল।

দত্তক ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে কনা ঘটনাক্রমে তাসলিমা নামে এক নারীর খোঁজ পান। কনা যে এলাকায় জন্মেছেন, এই নারীও সেই এলাকার। তাসলিমা বহু বছর আগে তার বোন নাসিমাকে হারিয়েছেন। বোনকে খুঁজে পেতে তিনি কনার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন। কনা একটি হোটেলে ওই নারীর সাথে দেখা করেন।

কনা এই নারীর সাথে তার পারিবারিক কোনো মিল রয়েছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি তাসলিমার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। তার বর্ণনার সাথে কনা নিজের তথ্যগুলো মেলানোর চেষ্টা করেন।

কনা বলেন, 'কনা ওই নারীর বর্ণনার সাথে তার কিছু বিষয়ে মিল পান, আবার কিছু বিষয়ে অমিল পান।'

কনা বলেন, 'তাসলিমা জানায় তার বোনের নাম ছিল নাসিমা। আমার মনে হয়নি যে আমিই নাসিমা হতে পারি। কারণ আমার জন্ম সংক্রান্ত কাগজে কনা নামটিই রয়েছে। তারপর আমি ওই নারীর কাছে আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টে যেই গ্রামের নাম রয়েছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তখন তাসলিমা জানান যে তারা আগে ওই গ্রামেই থাকতেন।

কনা তখনও আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে নাসিমার কোনো জন্মচিহ্ন আছে কিনা। এর উত্তরে তাসলিমা জানান, তার মা প্রায় দিনই ঘুমানোর সময় তার কাছে তার হারিয়ে যাওয়া বোনের গল্প করতেন। তার মা বলেছিল যে তাদের দুজনের পায়েই জন্মচিহ্ন রয়েছে।

এ কথা শুনে বিস্মিত হন কনা। কারণ তার হাঁটুতে এরকমই চিহ্ন রয়েছে।

তারপরও কনার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তাই তিনি ওই নারীর সাথে হোটেলটির টয়লেটে যান। সেখানে তারা নিজেদের পায়ের সেই জন্মচিহ্ন একে-অপরকে দেখান।

সেই মুহূর্তেই তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন।

কনা বলেন, 'আমি শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে মিল পেলাম। তার আর আমার পায়ের সাথে অদ্ভুত মিল রয়েছে।'

হাসতে হাসতে কনা বলেন, 'সেই অনুভূতি ছিল অসাধারণ। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আমি এটি পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না।'

এরপর কনা নেদারল্যান্ডসে ফিরে যান এবং ডিএনএ রিপোর্টের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাদের দেখা হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ডিএনএ রিপোর্ট হাতে আসে। আর তাতে দেখা যায়, ওই নারী আর কেউ নন, কনারই বোন।

কনা বলেন, 'আমি হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। তখন ডাক্তার আমাকে ফোন করে ডিএনএর রিপোর্টের ফলাফল জানায়। অবশেষে আমি মেনে নিতে পারলাম যে তিনি আমার বোন।'

তিনি বলেন, 'এ খবর শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা ধরে আসে। আমি রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেখানেই কান্না শুরু করি। আমি এক ঘণ্টার মতো কেঁদেছিলাম।'

যাকে তিনি বছরের পর বছর ধরে খুঁজেছেন, আজ তাকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। এর পর শিশু বয়সে কনাকে কীভাবে বিদেশে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, তাসলিমার কাছ থেকে সেই গল্পও শোনেন তিনি।

তাসলিমা কনাকে জানায়, তাদের মা কনাকে দত্তক দিতে চাননি। তাদের বাবার তিনজন স্ত্রী ছিলেন। নাসিমার মা তখন অসুস্থ থাকায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তখন তাদের আরেক মা নাসিমাকে বাড়ির কাছেই একটি ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে আসার জন্য তাদের বাবাকে রাজি করিয়েছিল।

ছবি: কনা ভেরহুলের সৌজন্যে

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর নাসিমার মা যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নাসিমাকে এর আগেই নেদারল্যান্ডসের একটি পরিবারের কাছে দত্তক হিসেবে দেওয়া হয়। সেই পরিবারটি ভেবেছিল নাসিমা অনাথ।

কনা জানায়, এ কারণে তার মা তার বাবাকে ডিভোর্স দিয়েছিল।

কয়েক দশক ধরে কনা বাংলাদেশে তার স্বজনদের খুঁজে বেরিয়েছেন। বোনকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে তার নিজের অতীত সম্পর্কে যে ক্ষোভ ও দুঃখ ছিল তা নিমিষেই হারিয়ে গেছে।

কনা বলেন, '২০১২ সালে আমার বাবা মারা গেছেন, মা মারা গেছেন ২০১৪ সালে। অথচ যখন আমি টঙ্গীতে তাদের খুঁজেছিলাম, তখন তারা জীবিত ছিলেন। একটি পর্যায়ে আমি আমার বাবার ঘরের দোড় গোড়ায় পৌঁছেছিলাম। এটি এখনও আমাকে কষ্ট দেয়।'

এদিকে দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ব্রাজিল থেকে বাবা-মার কাছ থেকে তাদের শিশুদের চুরি করা হচ্ছে বা কেনা হচ্ছে। এর পর ২০২১ সালে ডাচ সরকার বিদেশ থেকে শিশুদের দত্তক নেওয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করে।

১৯৭৩ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বহু শিশুকে অবৈধভাবে বিদেশে দত্তক নেওয়া হয়েছে- এমন দাবি বহু বছরের। গত বছর গার্ডিয়ানে এ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশের পুলিশ অনুসন্ধানে নামে।

২০১০ এর দশকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশ থেকে দত্তক ব্যক্তিরা নিজেদের সাথে পরিচিত হতে শুরু করেন। একটি ফোরাম গঠন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে দত্তক ব্যক্তিদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ হতে শুরু হয়।

কনা বলেন, 'দত্তক হিসেবে কেউ নিজেকে একা মনে করতে পারে। কিন্তু এখন আমরা একে-অপরের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমাদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।'

তিনি বলেন, 'অনেকেই এ ফোরামে যুক্ত হওয়ার পর দেখতে পান যে এই ফোরামে তাদের ভাই-বোনও রয়েছে। অনেকেই নেদারল্যান্ডসেই তাদের ভাই-বোন রয়েছে জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।'

পরে গোষ্ঠীটি বুঝতে পারে যে তাদের ধারণার চেয়েও সমস্যাটি আরও বড়। তাই ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডসে দত্তক ব্যক্তিদের বাংলাদেশে স্বজনদের খুঁজে পেতে সহায়তা করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় শাপলা।

সংস্থাটি উভয় দেশেই মাঠ পর্যায়ে কর্মী নিয়োগ দেয়। এর মাধ্যমে তারা দত্তক ব্যক্তিদের স্বজনদের খুঁজে বের করার কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তারা একটি ডিএনএ ডেটাবেইজ স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তির দত্তক সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহে রাখছেন।

শাপলার মাধ্যমে কয়েক মাসের মধ্যেই বহু মা তাদের সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসেও বহু মানুষ নিজেদের ভাই-বোনকে খুঁজে পেয়েছেন। এই সংস্থার মাধ্যমেই এক মেয়ে জানতে পারেন তার যমজ বোনকেও তার সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আলাদা দুটি পরিবারে বড় হয়েছেন।

দুই সন্তানের জননী কনা বলেন, কাগজপত্রে লেখা রয়েছে যে আমার সড়ক দুর্ঘটনায় এবং মা অসুস্থতায় মারা গিয়েছিলেন। এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তিনি বলেন, 'দত্তক হিসেবে হয়ত আপনি প্রায়ই শুনে থাকবেন যে আপনি খুবই ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। এখন আপনার একটি সুন্দর জীবন আছে। কিন্তু আপনি এই দুটির মধ্যে তুলনা করতে পারবেন না। একদিকে আমি ভাগ্যবতী। কারণ আমার দুই পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু আপনার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কখনোই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ আমি আমার পরিবার ও আসল পরিচয় হারিয়েছি।'

শাপলা এবং নেদারল্যান্ডসের অন্যান্য গোষ্ঠী এভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে দত্তক নেওয়া বন্ধে প্রচার চালিয়ে আসছে। গোষ্ঠীটি বিশ্বাস করে যে আন্তর্জাতিকভাবে এই দত্তক নেওয়ার পরিবর্তে অসহায় পরিবারগুলোকে সহায়তা করা, কিশোর পরিচর্যা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং যেসব দেশ থেকে এভাবে দত্তক নেওয়া হয় সেই দেশগুলোতে শিশু-কিশোরদের যত্নের মান উন্নত করার দিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

তাদের যুক্তি জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যা শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। কনা এর এর তার অন্য ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেই সঙ্গে তার পাসপোর্টে উল্লিখিত গ্রামে সম্প্রতি একটি প্লটও কিনেছেন।

কনা বলেন, 'আমি সেখানে বাড়ি বানাতে চাই। আমার বোন চাইলে সেখানে থাকতে পারবে। আমি সেখানে সময়ও কাটাতে পারব।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.