বিবিএসের স্বাস্থ্য খাতের তথ্য উত্তরের চেয়ে প্রশ্নেরই বেশি উদ্রেক করে

বাংলাদেশ

19 December, 2023, 02:25 pm
Last modified: 19 December, 2023, 02:27 pm
নভেম্বরে গ্রামে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের বেশি নেগেটিভ হওয়ার কথা বলা হয়েছে...
ইনফোগ্রাফিক্স: টিবিএস

জুন থেকেই শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার উচ্চ অবস্থানে রয়েছে, নভেম্বরে এই ব্যবধান আরও প্রায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে।  

কিন্তু, গেল ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত স্বাস্থ্য খাতের মূল্যস্ফীতির তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। যেখানে নভেম্বর মাসে গ্রামে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক বা নেগেটিভ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও এসময় শহরে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। 

বিবিএসের তথ্যে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় ব্যাপকভাবে কমার কথা বলা হয়েছে; যার প্রভাবে গত তিন মাসের সাধারণ স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতিও (গ্রাম ও শহর মিলিয়ে) ঋণাত্মক হয়েছে।

কিন্তু, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ওষুধ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা চিকিৎসকের ফি কমেছে এমন কোনো চিত্র বাজার বিশ্লেষণে পাওয়া যায়নি। বরং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে থাকা ও খুচরাভাবে বিক্রি করা– উভয় ধরনের কিছু ওষুধের দাম অনেকটাই বেড়েছে। 

এ অবস্থায়, মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক হওয়ার কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না বিবিএস, তবে কর্মকর্তারা আভাস দেন যে, স্বাস্থ্য খাতে মূল্যস্ফীতি নিরুপণের পণ্য ও সেবা মূল্যতালিকা (স্বাস্থ্য বাস্কেট) পুনর্বিন্যাস এবং নতুন হিসাব পদ্ধতির ফলে মূল্যস্ফীতি নেগেটিভ হয়ে থাকতে পারে।    

এদিকে বাজার তথ্য বিশ্লেষণে করে দেখা যায়, বিবিএসের স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতির তালিকায় বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি। নভেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হার – ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশের – উচ্চ অবস্থানেই ছিল।    

বিবিএসের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে শহরাঞ্চলের স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ, অক্টোবরে যা হয় ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে এবং নভেম্বরে এই হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশে। 

এরই পাল্টা স্বজ্ঞাত উপায়ে, গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতির তথ্য উল্টো পথে যায়। এই তিন মাসে গ্রামে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতির হার যথাক্রমে– মাইনাস ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, মাইনাস ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং মাইনাস ৭ দশমিক ০১ শতাংশ প্রতিবেদিত হয়েছে।  

আলোচিত মাসগুলোতে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি যথাক্রমে- মাইনাস ৩ দশমিক ৯২, মাইনাস ১ দশমিক ৭৩ ও মাইনাস ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ হারে হওয়ার প্রভাবেই মূলত গ্রাম ও শহর মিলিয়ে – সাধারণ স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতিও – এসময়ে নেগেটিভ হয়। 

কোন মাসের স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি হার নেগেটিভ বা ঋণাত্মক হওয়ার মানে– ওই সময় স্বাস্থ্য খাতের যেসব পণ্য বা সেবা আমরা ক্রয় করেছি, যেমন ঔষধ, ডাক্তারের ফি, বা স্বাস্থ্য উপকরণের দাম– আগের বছরের একই মাসের তুলনায় কমেছে। 

ইনফোগ্রাফিক্স: টিবিএস

বিবিএস যা বলছে

তথ্যের এই গোলকধাঁধার ব্যাখ্যা জানতে চারবার (গত ৬, ৭, ১০ ও ১১ ডিসেম্বর) বিবিএসের কার্যালয়ে যান টিবিএসের প্রতিবেদক। প্রথম দুইবার মূল্য ও মজুরি শাখার কর্মকর্তারা এবিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেন যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রস্তুত করতে মূল্যস্ফীতি গণনার একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের ম্যানুয়েল ২০২০ অনুযায়ী, বর্তমান মূল্যস্ফীতি বাস্কেট পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এ ছাড়া, গত এপ্রিল মাস থেকেই ২০০৫-০৬ এর পরিবর্তে ২০২১-২২ অর্থবছরকে নতুন ভিত্তি বছর করা হয়েছে। এটাই মূল্যস্ফীতি হার নেগেটিভ হওয়ার কারণ। 

সাধারণ মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়, পয়েন্ট - টু - পয়েন্ট ভিত্তিতে। অর্থাৎ, চলতি বছরের নভেম্বরে মূল্য বৃদ্ধির হার , গত বছরের একই সময়ের সাথে তুলনা করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।

এই প্রেক্ষাপটে, মূল্যস্ফীতি বাস্কেটের পরিবর্তনের কারণে ২০২২ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের নভেম্বরের স্বাস্থ্য বাস্কেট তুলনাযোগ্য কিনা – তা বিবিএসের কর্মকর্তারাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়।

জবাবে তারা বলেন, এটা তুলনাযোগ্য, তবে খুব জোরালোভাবে নয়। ,

তাঁরা আরও ব্যাখ্যা দেন যে, নতুন পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত করে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের বাস্কেট পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নতুন এই বাস্কেটে রয়েছে প্রায় ৩৬টি পণ্য, যা আগে ২২টি ছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। 

বাস্কেটে কি কি পরিবর্তন হয়েছে, বা নতুন কোন কোন পণ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে– সেবিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য দেননি কর্মকর্তারা। 

গত ১০ নভেম্বর বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান নেগেটিভ মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে একই ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু, নতুন ও পুরোনো বাস্কেটের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্যগুলো কোথায়– তার বর্ণনা দিতে পারেননি। তবে মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে বিবিএসের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত বছরে স্বাস্থ্য খাতের দুটি পণ্যের দাম অনেক বেশি ছিল। এবছর এসব পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি নেগেটিভ হয়ে গেছে। এ দুটি পণ্য কী তা জানাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এক দিন সময় বেধে দেন মহাপরিচালক।

পরদিন ১১ ডিসেম্বর মিজানুর রহমান জানান, গ্রামে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি কমার পেছনে যে দুটি পণ্যের কথা জানানো হয়েছিল, সেগুলো বিবিএসের কর্মকর্তারা খুঁজে বের করতে পারেননি। 

বাজার বিশ্লেষণ যা বলছে…

গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য উপকরণের দাম পর্যালোচনা করেছেন টিবিএসের স্থানীয় প্রতিনিধিরা। কিন্তু, গত এক বছরে এসব পণ্য বা সেবার দাম কমার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা ডাক্তারের ফি কমারও কোনো প্রমাণ মেলেনি। 

একাধিক জেলার উপজেলা পর্যায়ের ওষুধের দোকান মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ওষুধগুলোর দাম বেড়ে গেছে।

কুষ্টিয়ার প্রাগপুর ইউনিয়নের তিয়াশ ফার্মেসির সত্ত্বাধিকারী ফারহান ইশরাক টিবিএসকে বলেন, 'প্রেসক্রিপশনে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ থাকে এমন ওষুধগুলোর দাম গত এক বছরে কিছুটা বাড়িয়ে সমন্বয় করা হয়েছে। যেমন এক বছরে নাপা সিরাপের দাম ১৫ টাকা এবং ওরস্যালাইনের দাম প্যাকেটে ১ টাকা বেড়েছে। 

বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ- ২০২২ এ দেখা গেছে, উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে ১০ শতাংশ পরিবার চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে না, অন্যদিকে ৮২ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুতর মনে না করে– চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে না।  

চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের জন্য ওষুধের দামও দায়ী, তারপরেই রয়েছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ। সে তুলনায়, চিকিৎসকের ফি নিয়ে ততোটা ভাবনা নেই জনসাধারণের, কারণ ৬৬ শতাংশ খানাই স্থানীয় ফার্মেসি বা অদক্ষ চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে স্বাস্থ্য পরামর্শ নেয়।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক বিচারে ওষুধ কিনতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। গড় মাসিক আয়ের একটি খানা বা পরিবারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পেতে খরচ হয় এক হাজার ৩৭৮ টাকা, ওষুধের পেছনে খরচ হয় ৭৪৯ টাকা, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ ৩৫৫ টাকা ও চিকিৎসকের পরামর্শক ফি ১৪২ টাকা।

শহরে চিকিৎসা ব্যয় গ্রামের চেয়ে কিছুটা বেশি বলে খানা আয় ও ব্যয় জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি এম শাফিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, চলমান ডলার সংকটের মধ্যে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে, একারণে গত বছরের চেয়ে এবার ওষুধের দাম কিছুটা বেড়েছে। তাঁর মতে, 'ওষুধের দাম দাম আরও বাড়ানো দরকার, কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিচ্ছেন না।'  

বিবিএসের মেথডলজি নিয়ে প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের 

বিবিএসের মেথডলজি বা কার্যপ্রণালীর কারণে যদি হিসাবে ভুল হয়, তাহলে কেন তারা সেটি ব্যবহার করবে? - এ প্রশ্ন রাখেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।  

তিনি বলেন, নতুন মেথডলজির কথা যদি আইএমএফ বলেই থাকে, তাহলে বিবিএস কেন আইএমএফকে এটা বলবে না যে, নতুন পদ্ধতি বাস্তব চিত্র দিচ্ছে না। 

স্বাস্থ্য বাস্কেট এর পরিবর্তনের কারণে যদি ভুল তথ্য উঠে আসে, তাহলে পদ্ধতিটি সংস্কার করার পরামর্শ দেন তিনি।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ টিবিএসকে বলেন, বাস্তবসম্মতভাবে স্বাস্থ্য মূল্যস্ফীতি তুলে আনতে বাস্কেট হালনাগাদ করা ভালো। 'কিন্তু পরিবর্তন করা হলে আগের বাস্কেটের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। এই তুলনা করাটা ভুল। এক্ষেত্রে আগের বাস্কেটের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল রেজাল্টে আসবে।'

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.