প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বিদেশি ঋণ চাইছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

03 December, 2023, 11:20 pm
Last modified: 03 December, 2023, 11:24 pm

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অর্থায়ন কমে আসায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং তাদের কারণে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের শিকার স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে এক বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ প্রত্যাশা করছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, এর মধ্যে অনুদান হিসেবে ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার ও ঋণ হিসেবে ৫৩৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চূড়ান্ত করতে দুই সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ প্যাকেজের লক্ষ্য জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তার মোকাবিলা করা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের উপস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব প্রশমন করা।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় এবারই প্রথমবারের মতো ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ।

এর আগে মানবিক সহায়তা হিসেবে শুধু বিদেশি অনুদান গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। আর রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি তাদের আশ্রয়দানকারী দেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং আর্থ-সামজিক উন্নয়নে নেয়া প্রকল্পগুলোও ছিল অনুদাননির্ভর। কিন্তু এখন বিদেশি অনুদান আসা কমে গেছে। ছয় বছরের বেশি বয়সি প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আগে যেখানে ১২ ডলার বরাদ্দ ছিল, এখন সেই বরাদ্দ নেমে এসেছে ৮ ডলারে। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে খাবার পায়।

এই নতুন ঋণের কারণে সৃষ্ট ঋণের বোঝার জন্য ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় 'জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান'-এর আওতায় প্রয়োজনীয় অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মানবিক অনুদান সংগ্রহের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা উচিত।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ দেশের সম্পদ ও অবকাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের চাপ তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বেশি, যেখানে সিংহভাগ রোহিঙ্গা বসবাস করে।

অনুদান কমে আসায় ঋণ দরকার

নভেম্বরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পর সংস্থাটি ৩১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান ও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ মিলে মোট ৭০০ মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া ১৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও একই পরিমাণ অনুদান মিলে মোট ৩০০ মিলিয়ন ডলার দিতে এডিবির পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে।

সভায় ইআরডির সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বলেন, রোহিঙ্গা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য অনুদানের উৎস কমে আসায় সরকারের জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। 

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের উইন্ডো ফর হোস্ট কমিউনিটিজ অ্যান্ড রিফিউজিস-এর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-২০ উদ্যোগের আওতায় তিন বছরের জন্য ২.৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ আছে। বাংলাদেশ বছরে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ পেতে পারে।

আগে বিশ্বব্যাংক এই উইন্ডো থেকে শুধু ঋণের প্রস্তাব দিলেও আলোচনার পর ৩১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান ও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানান সচিব।

রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনসংখ্যার মৌলিক সেবা, পানি, স্যানিটেশন, সড়ক, বিদ্যুৎ, আশ্রয়কেন্দ্র উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ঘাতসহতা বাড়াতে এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রশমনে ব্যয় হবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তার অর্থ।

এছাড়া এডিবির সহায়তার অর্থ ব্যয় হবে সড়ক উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুতায়ন ও স্বাস্থ্য সেবা মানোন্নয়নে।

সভায় দুই সংস্থার সহায়তা পেতে দ্রুত আলোচনা এগিয়ে নিতে ইআরডিকে নির্দেশনা দেয়া হয়। 

তাছাড়া বিদেশি সহায়তা পেতে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়।

নতুন ঋণে আরও বাড়বে ঋণের চাপ

রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়া হলে ভবিষ্যতে দেশের ওপর ভবিষ্যতে ঋণের চাপ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের আওতায় মানবিক সহায়তা বাবদ চলতি বছর যে ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে, তার মাত্র ৪৫ শতাংশ পাওয়া গেছে। দাতা সহায়তা কমে যাওয়ায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার কারণে অর্থনীতি চাপে পড়ছে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান বের করা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।

রোহিঙ্গাদের কোনো কাজ করার অনুমোদন না থাকলেও তারা কাজ করছে, ফলে স্থানীয় লোকজনের বেকারত্ব বাড়ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান। 

তবে প্রত্যাবাসনে দীর্ঘ সময় লাগলে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।

সহায়তার অর্থ দিয়ে যেসব কাজ করা হবে

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভার নির্দেশনা মেনে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর থেকে দুটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের জন্য পুরো ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে। এর মধ্যে ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা মজবুতকরণ প্রকল্পে এবং ৪৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে কক্সবাজার ও নোয়াখালী জেলায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বাড়ানোর প্রকল্পে।

চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হলে প্রকল্পগুলি ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রবেশ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণ ও সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো, টেকনাফে একটি ভূগর্ভস্থ জলাশয়, ভাসানচরে পানি সরবরাহ ও পরিবহনের জন্য হাতিয়ায় একটি জেটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং পাশ্ববর্তী বাজার উন্নয়নের কাজ করবে। 

ভাসানচরে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, ক্লিনিকে সেবা দিতে রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ ও মূমূর্ষু রোগীদের জন্য ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের দায়িত্ব থাকবে নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রকল্প বাস্তবায়ন।

জরাজীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সংস্কার ও স্কুল ফিডিংয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সহায়তা বিতরণের পাশাপাশি মাটির রাস্তা ও এইচবিবি (হেরিং-বোন-বন্ড) রাস্তা নির্মাণ করবে।

হোস্ট কিমিউনিটির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। 

তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ক্যাম্প নির্মাণ এবং ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে নতুন ঘর নির্মাণ করা হবে আরেকটি প্রকল্পের আওতায়।

স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশের ওপর রোহিঙ্গাদের প্রভাব

সভায় বলা হয়, রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ, জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য এবং বনাঞ্চলের অনেক ক্ষতি হচ্ছে, যার মূল্য পুরো বাংলাদেশকেই দিতে হচ্ছে। 

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনসাধারণের বড় একটা অংশ বেকার হয়ে পড়েছে বলেও সভায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দিলেও অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণকে ব্যবসায় নিযুক্ত করার পরামর্শ দেন দেওয়া হয়।

সভায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনধারণের জন্য পৃথক প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মানুষের জন্য একই প্রকল্প নেওয়া যাবে না। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য এক বছরের বেশি মেয়াদি কোনো প্রকল্প প্রস্তাব করা যাবে না। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.