ইউজিসিতে মান বাঁচাতে ‘অছাত্রদের’ হলে রেখে ছাত্রদের নিয়ে অনলাইনে ক্লাস
ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ পাঁচ মাস পরেও নানান সংকটে প্রথম বর্ষের (২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ) ক্লাস শুরু করতে পারেনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অবশেষে সিট সংকটের দোহাই দিয়ে আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
গত ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে আবাসন সংকটের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাথে সম্পাদিত বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) মান রাখতে প্রশাসন ক্লাস শুরু করছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
মান বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে এপিএ স্বাক্ষর করে ইউজিসি। এছাড়া, ২০১৬ সাল থেকে এপিএ'র ওপর ভিত্তি করে র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক এ সংস্থা। এই র্যাংকিংয়ের ওপর ভিত্তি করে বাজেট নির্ধারণের কথা বলে আসছে ইউজিসি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ইউজিসি'র স্বাক্ষরিত বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি ২০২৩-২৪ থেকে জানা যায়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর প্রতিশ্রুত শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। এর আগে প্রতিশ্রুত চারটি তারিখ- ৩১ অক্টোবর, ৯ নভেম্বর, ১৬ নভেম্বর ও ২৩ নভেম্বর-পূরণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়। এই চারটি তারিখের যেকোনো একটিতে ক্লাস শুরু করতে পারলে ইউজিসি কর্মসম্পাদন সূচক মান ১ এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ১০০-৭০ শতাংশ নম্বর পেত। ৩০ নভেম্বর ক্লাস শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় চলতি মানের নিম্নে ৬০ শতাংশ নম্বর পাবে। মানের অবস্থা যখন খাদের কিনারে, ঠিক সেই সময় তড়িঘড়ি করে অনলাইনে ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) কমিটির সদস্য জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক মো: নুহু আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইউজিসির এপিএ র্যাংকিংয়ে আমরা ভালো করতে চাই। তবে শুধু সে কারণেই অনলাইনে ক্লাস শুরু করা নয়। ৩০ আক্টোবরেই ক্লাস শুরু করতে পারলে ভালো হতো। সেক্ষেত্রে আমরা সূচক মানের পুরো নম্বরটাই পেতাম। নতুন হলগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগে ইউজিসি আগে অনুমোদন দিলে আমরা তা করতে পারতাম।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো: নূরুল আলম বলেন, "এপিএ কে আমরা মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরছি না। এপিএ বা ইউজিসি র্যাংকিংয়ের চেয়ে বড় বিষয় হলো আমরা গণরুম কালচার তুলে দিতে চাই। সবার জন্য আসন নিশ্চিত করেই আমরা নতুন শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস শুরু করব।"
অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ায় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ভর্তি হওয়া তানজীন মুনা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা পদ্ধতি উচ্চ মাধ্যমিকের চেয়ে আলাদা। সে হিসেবে শুরুতেই অনলাইন ক্লাসে লেকচার ভালোভাবে আয়ত্ত করা অনিশ্চিত। শুরুতেই যদি ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে তা পুরো বছরই পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
এদিকে, ভর্তি পরীক্ষার ৫ মাস পরেও সশরীরে ক্লাস শুরু না করতে পারাকে প্রশাসনের ব্যর্থতা বলছেন দর্শনের অধ্যাপক রায়হান রাঈন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "ভর্তি পরীক্ষার পর কখন ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে, অপেক্ষমাণ তালিকা প্রকাশ হবে, কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে— তা আগেই নির্ধারণ করা থাকে। এপিএ চুক্তির মান রক্ষার জন্য হলেও আগেই ক্লাস শুরু করা উচিত ছিল। ক্লাস শুরু না করার পেছনে নতুন হল চালু না হওয়াসহ যে কারণগুলো প্রশাসন দেখিয়েছে, সেগুলো অযৌক্তিক।"
প্রশাসন চাইলেই এগুলো দূর করার উদ্যোগ নিয়ে অনেক আগে থেকে ক্লাস শুরু করতে পারত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
'অছাত্রদের' হলে রেখে ছাত্ররা অনলাইনে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮ এর ৫(ট) ধারা অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার ৭দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ আবাসিক হল ত্যাগ করার বিধান রয়েছে। এর ব্যতয়ে প্রশাসন পরীক্ষার ফলাফল স্থগিত করবে।
তবে কাগজে-কলমে থাকা এই বিধান মানেন না অনেকেই। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও তেমন উদ্যোগ চখে পড়ে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, চারুকলা বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগ ছাড়া বাকি সব বিভাগে ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবে হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, এখনও ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ ব্যাচের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছেন।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিনিয়র ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থীই অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। ৪ আসনের একটি কক্ষ দখল করে দুইজন করে ছাত্রলীগের নেতা থাকছেন। দুই আসনের কক্ষগুলোতে থাকছেন একজন করে।
আর এদিকে, অবৈধভাবে অবস্থান করা এসব শিক্ষার্থীদের চাপ পড়েছেন বৈধ শিক্ষার্থীরা; বিশেষত যারা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের জায়গা হয়েছে গণরুমে। একক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছেন ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী। কোনো রকমে শোওয়ার জায়গা হলেও পড়াশোনার ন্যূনতম পরিবেশ তারা পাচ্ছেন না তারা।
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী (৫১তম ব্যাচ) বলেন, "জাহাঙ্গীরনগর একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জেনেই ভর্তি হওয়া। হলে ওঠার সময় আমার একটা সিট ও পড়ার টেবিল পাওয়ার কথা। কিন্তু ভর্তির এক বছর হলেও সেই সিট পাইনি, পড়ার টেবিল তো পরের কথা। চারজনের রুমে গাদাগাদি করে, ফ্লোরিং করে ১০-১২ থাকতে হয়।"
এর আগে, সামিউল ইসলাম প্রত্যয় নামের এক শিক্ষার্থীর সিটের দাবিতে আন্দোলনের মুখে গত ৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৭দিনের মধ্যে অবৈধ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেন। তবে প্রশাসনের জারি করা আদেশে ভ্রুক্ষেপ করেননি অবৈধভাবে অবস্থানকারীরা। এরপর ১৯ মার্চ দ্বিতীয় দফায় নোটিশ জারি করে প্রশাসন। এরপরেও কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। এরজন্য হল প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন আন্দোলনকারীরা।
অধ্যাপক রায়হান রাঈন বলেন, "প্রশাসন এখন গণরুমের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, কিন্তু এই ব্যবস্থার পেছনের কারণ তারা বলছে না। হলগুলোতে এখনো অনেক অছাত্ররা আছেন। তাদের হল ছাড়ার বিষয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না।"
প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক নিগার সুলতানা বলেন, "হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের ইতোমধ্যে আমরা নোটিশ পাঠিয়েছি। হল ক্লিয়ারেন্স সনদ না দেওয়া পর্যন্ত আর কোনো শিক্ষার্থীর ফলাফল প্রকাশ করা হবে না এবং হলে আবস্থানকারী কাউকে হল ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হবে না।"
"৪৬তম ব্যাচের প্রায় ৯০ ভাগ বিভাগের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আমারা তাদের বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেব।"
হলে সিট বণ্টন করে ছাত্রলীগ
হল তদারকিতে হল প্রশাসনের চরম উদাসীনতার অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
তাদের দাবি, প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে হলে সিট পেতে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে হয়। ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা আসন বরাদ্দ দেন; ফলে রাজনীতির সাথে যুক্তরাই আগে সিট পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দ্বিতীয়বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, "আমি কোন রুমে থাকছি, কোন হালতে আছি তা হল প্রভোস্ট জানেন না। কখনো জিজ্ঞেসও করেন না। এ সম্পর্কিত কোনো নথিও তাদের কাছে নেই। ফিস্টের সময় এবং হলে কোনো ঝামেলার সময় ছাড়া প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন ও আবাসিক শিক্ষকদের একসাথে দেখা মেলে না। হলে সিট দেয় ছাত্রলীগ।"
এদিকে, হলে সিট বণ্টনে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, "সিট দেওয়ার এখতিয়ার ছাত্রলীগের নেই। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। জাবি ছাত্রলীগ সিট বাণিজ্যের রাজনীতি করে না। আমরা বরং হলের যেকোনো সমস্যা সমাধানে প্রশাসনকে তাগিদ দেই।"
অবৈধভাবে কক্ষ দখল করে থাকার বিষয়ে সোহেল বলেন, "এরকম কিছু আমার জানা নেই। তবে কেউ অবৈধভাবে হলে অবস্থান করলে কিংবা ৪ জনের রুমে ২ জন অবস্থান করে থাকলে তা অন্যায়। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হবে।"
হলে ছাত্রলীগের সিট বণ্টনের বিষয়ে অধ্যাপক নিগার সুলতানা বলেন, "এই তথ্য আমার কাছে নতুন। কোন শিক্ষার্থী কোন হলে এবং কত নাম্বার কক্ষে আছে, হল প্রশাসনের কাছে সে তথ্য রয়েছে। সিট বণ্টনের বিষয়ে হল প্রশাসন কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে আলোচনা করে না।"