রেল দুর্ঘটনা: প্রতিরোধের উদ্যোগ কম, সুপারিশও মানা হয় না 

বাংলাদেশ

25 October, 2023, 09:40 am
Last modified: 25 October, 2023, 09:47 am
শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, সনাতনী সঙ্কেত ব্যবস্থা, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং আর জনশক্তির অভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও তদন্ত কমিটি গঠনের মধ্যেই নিরাপদ রেল প্রতিষ্ঠার কাজ সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১৩ জন নিহত হলে রেলের দুই তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা এড়াতে লেভেল ক্রসিংয়ে উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম, জনবলের সংকট দূর করা ও রেললাইনের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সুপারিশ করে।

এর আগের বছরের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের খুলশীর ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি একই সুপারিশ করলেও ভূমি উদ্ধারে দৃশ্যমান কিছু কিছু অভিযান চালানো ছাড়া গত দুই বছরে সুপারিশ পালনে কোন উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ রেলওয়ে।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, সনাতনী সঙ্কেত ব্যবস্থা, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং আর জনশক্তির অভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও তদন্ত কমিটি গঠনের মধ্যেই নিরাপদ রেল প্রতিষ্ঠার কাজ সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

দায়ীদের চিহ্নিত না করার ধারাবাহিকতায় সোমবার ভৈরববাজার রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭ জন। এ ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুইটি ও রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি কাজ শুরুর আগেই তিনজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

রেল দুর্ঘটনার পর তদন্তের মাধ্যমে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের নজির দেখা যায় না বলে মনে করেন রেলপথ মন্ত্রনালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীরও।

ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে অনুষ্ঠিত এক সভায় গত বছরের আগস্টে তিনি বলেছিলেন, ট্রেনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা পরে জানাবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। রেলের কর্মকর্তাদের কাজে সমন্বয়ের অভাব আছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ওই সভায় বাংলাদেশ রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেছিলেন তদন্তকারী কর্মকতারা এক বিভাগ অন্য বিভাগকে দায়ী করে। এতে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয় না এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেশের বাইরে থাকায় ওই সভার এক বছরের বেশি সময় পরে রেলের দুর্ঘটনা রোধে ও তদন্তের সুপারিশ বাস্তবায়নে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এ বিষয়ে তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সুপারিশের আলোকে দায়ীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির রয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, মন্দবাগে রেল দুর্ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া লোকো মাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার ও গার্ডকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগে দুইটি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার পর আর কোন ঘটনায় কেউ শাস্তি পেয়েছেন বলে তথ্য দিতে পারেননি মহাপরিচালক।

বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১০ মাসে রেলের ২২৬ দুর্ঘটনায় ২৪১ জন মারা গেছেন। আর আহত হয়েছেন ২৪৮ জন। আর ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১১৬ দুর্ঘটনায় মোট ১৩৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই কোন তদন্ত হয়নি বলে মন্তব্য করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।

তিনি বলেন, "দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়। কমিটির কয়েকটি সভা হয়। কখনও প্রতিবেদন জমা পড়ে আবার কখনও জমা পড়ে না। এরই মধ্যে হয়ত অন্য কোন দুর্ঘটনা ঘটে আর নতুন তদন্ত কমিটি হয়।"

তিনি বলেন, নিচের দিকের কর্মীদের বহিষ্কারের মাধ্যমে সব কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলায় রেলের দুর্ঘটনা কমছে না। রেলের দুর্ঘটনা এখন 'স্ট্রাকচারাল কিলিং'য়ে পরিণত হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সমস্য চিহ্নিত আগেই

রেলপথে দুর্ঘটনার কারণগুলো অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত করা আছে মন্তব্য করে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, দুর্ঘটনার কারণ সবাই জানেন তবে প্রতিরোধের উদ্যোগ খুবই কম।

তিনি আরও বলেন, নতুন রেলপথ নির্মাণে বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে যতটা আগ্রহ আছে তার সামান্য অংশও নেই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে জনসাধারণকে মানসম্মত সেবা দেয়ায়।

তিনি বলেন, নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে, অথচ সিগনালিংয়ে ব্যবহার হচ্ছে শতবছরের পুরাতন এনালগ পদ্ধতি। একই লাইনে একাধিক ট্রেন ঠেকানোর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।

রেলওয়ের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে রেলপথ মন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রেল দুর্ঘটনায় দায়দায়িত্ব নির্ধারণে সুপারভাইজিং অফিসারদের যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

ওই সভায় বলা হয়েছিল, রেলওয়ের জনবলের অভাব থাকায় একজনকে তিন থেকে চার জনের কাজ করতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রায় এক হাজার বেধ ও অবৈধ লোকবলবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে শামসুল আলম বলেন, রেলের দুর্ঘটনায় রেলের অফিসাররা তদন্ত করলে প্রকৃত দায়ীদের চিহ্নিত করা কঠিন।

এ ধরনের কমিটি রেলের কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায় চিহ্নিত করতে উৎসাহী হয় না। অনেক সময় প্রকৃত দায়ীরাই এই সব কমিটিতে থাকেন।

এ অবস্থায় রেলের দুর্ঘটনা তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.