সরকারের ভালো কার্যকর নীতি যেভাবে চালের দাম স্থিতিশীল রেখেছে

বাংলাদেশ

08 October, 2023, 12:00 am
Last modified: 08 October, 2023, 04:27 pm

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

দেশের বাজারে অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমে বেড়েই চলেছে। ফলে নিম্ন-আয়ের মানুষের রোজগারের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এরমধ্যেই তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির জায়গা চালের বাজার। চলতি বছর চালের দর স্থিতিশীল রয়েছে, এমনকী সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা কমেছে।   

আগস্টে ১০ শতাংশের নিচে থেকে হঠাৎ করেই বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে পৌঁছায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসময়ে প্রায় প্রতিবেলার খাবারে বেশি খাওয়া হয়, এমন বিভিন্ন পণ্য – ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে খাদ্যমূল্যের এ সূচক কিছুটা কমলেও, তা ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়ার মতোন যথেষ্ট কম হয়নি।

দর বেঁধে দেওয়া, বাজারে তদারকিতে অভিযান ও আমদানির সিদ্ধান্তসহ– সরকারের সব রকম উদ্যোগকে অবজ্ঞা করেই বাজারে বাড়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম। চিনি ও সয়াবিন তেলের দামও ছিল উচ্চ।

এই অবস্থায়, আরও একবার ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন দেশের কৃষকরা, ঠিক যেমনটা তারা মহাকারিকালেও হন উৎপাদন অব্যাহত রেখে। দুই মৌসুমের ধারাবাহিক ভালো ফলনের সুবাদে ঊর্ধ্বগতির বাজারে একমাত্র ব্যতিক্রম চাল, কৃষি উপকরণের মসৃণ সরবরাহ যার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ফলে সরকারও চালের বাড়তি মজুদ তৈরিতে সহায়তা পেয়েছে, এবং কার্ডধারী এক কোটি পরিবারের জন্য প্রতিমাসে ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রি অব্যাহত রাখতে পেরেছে।

সংকটের এই সময়ে ভালো নীতি গ্রহণ ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন কাজে দিয়েছে। এবছরের এপ্রিলে পাস হওয়া খাদ্যশস্যের মজুত-বিরোধী আইন, এবং আগেভাগে আমদানির সিদ্ধান্ত চালের বাজার দরকে স্থিতিশীল রাখার সহায়ক হয়েছে।

ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, প্রতিকূল জলবায়ু পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার কৃষকদের অন্য ফসল চাষে ঝুঁকে পড়াসহ বিভিন্ন ঘটনায় আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এই অবস্থায়, বিশ্ববাজার দর ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছালেও– সরকারের আলোচিত পদক্ষেপগুলোর সুবাদে বাংলাদেশে চালের বাজার বিস্ময়করভাবে স্থিতিশীল থাকতে পেরেছে।

চালের বাড়তি দর যাতে খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে উস্কে না দেয়, সেজন্য গত মাসে চালের মূল্যসীমা বেঁধে দেয় ফিলিপাইন। এদিকে চলমান ডলার সংকট সত্ত্বেও– এই মুহূর্তে তাৎক্ষনিকভাবে চাল আমদানির চাপমুক্ত আছে বাংলাদেশ।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, 'উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমছে। শীর্ষ উৎপাদকদের মধ্যে একদিকে ভারত চালের রপ্তানি বন্ধ করেছে, অন্যদিকে ভিয়েতনাম রপ্তানি সীমিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে চালের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু এই উত্তাপটা আমাদের গায়ে লাগছে না, কারণ সবশেষ আমন ও বোরো মৌসুমে আমরা ভালো ফলন পেয়েছি।

তিনি বলেন, 'মাঠে এখন আমন চাষ হচ্ছে এবং ফলনের পূর্বাভাসও ভালো। অন্যদিকে, সরকার অবৈধ মজুত ঠেকাতে আইন পাস করেছে, যেখানে অবৈধ ব্যবসায়ীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখেছে। সব মিলিয়ে এখন আমরা ভালো পজিশনে আছি, যা চালের দাম কমাতে বা স্থিতিশীল রাখতে সহযোগিতা করছে।'

মূল্যস্ফীতিতে চালের দরের প্রভাব

জাতীয় পর্যায়ে বা শহর ও গ্রামের পরিবারগুলোর গড় আয়ের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এই সূচকগুলো ব্যবহার করে শহর, গ্রাম ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার গণনা করা হয়।

খাদ্য, অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে ভোগ্যপণ্যের তালিকা বা 'কনজ্যুমার বাস্কেট' নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরে ভোক্তা মূল্য সূচকের ভিত্তি বদলেছে বিবিএস। এবার ভোগ্যপণ্যের তালিকায় খাদ্যপণ্যের পরিমাণ ছিল ৪৮ শতাংশ, যা এর আগে ছিল ৫৬ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর নতুন হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলের ভোগ্যপণ্য তালিকায় চালের অংশ ২৬ দশমিক ১৫ শতাংশ, আর শহরাঞ্চলে তা ১৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

এদিকে আগস্টে ১২ বছরে মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে পৌঁছে যায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি।

চালের দাম স্থিতিশীল থাকা অবস্থায়, গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫১ শতাংশে পৌঁছালে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তে হবে।

একইভাবে, (চালের দাম স্থিতিশীল থাকা অবস্থায়) শহরাঞ্চলে ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম এভাবে বাড়ার পরেও, একমাত্র চালের দামে স্থিতিশীলতা থাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল, নাহলে আরও বেশি হতো।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, অন্যান্য পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যেতে পারত। খাদ্য তালিকায় চালের ওয়েট বেশি থাকার কারণে চালের দাম বাড়লে এর প্রভাবও মূল্যস্ফীতিতে বেশি হবে। আর চালের দাম স্থির থাকার পরেও ১২ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির মানে দাঁড়ায়- অন্যান্য পণ্যের দাম অনেক বেশি হারে বেড়েছে।'

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগসমূহ

বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও, বাংলাদেশের বাজারে প্রায় সব ধরনের/ মানের চালের দাম কমেছে। ব্যবসায়ীদের মতে, এর পেছনে ভালো ফলন ও কঠোর মজুত-বিরোধী আইনের পাশাপাশি, সরকারিভাবে এক কোটি পরিবারের কাছে ভর্তুকিমূল্যে পাঁচ কেজির চালের বস্তা বিক্রির উদ্যোগও অবদান রেখেছে রেখেছে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও ঢাকার বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, মোটা চালের দাম এখন ৪৮-৫০ টাকা, মাঝারি মানের চিকন চাল ৫৫-৬০ টাকা এবং ৬০-৭২ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মানের চিকন চাল।

তবে টিসিবির ২০২২ সালের জুন মাসের বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, ঐ সময় এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়ে ৫৩-৫৪ টাকা, মাঝারি মানের চালের দাম ৯ দশমিক ৮০ শতাংশের বেশি বেড়ে ৬০-৬৫ টাকা এবং চিকন চালের দর ১৫ শতাংশ বেড়ে ৮০ টাকা ছাড়িয়েছিল।

রাইসমিল (চালকল) মালিকরা টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে ধান ও চালের বাজারে কোন অস্থিরতা নেই। মিলগেটে মোটা চালের কেজি ৪৩ টাকা, চিকন চালের কেজি ৪৮-৪৯ টাকা এবং মাঝারি মানের চিকন চাল (বিআর-২৯ এর মতোন জাত) এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকায়। মিলাররা কৃষকদের থেকে মোটা চালের ধান কিনছেন ৩০ টাকা কেজি দরে, চিকন ধান ৩৪ টাকা এবং মাঝারি চিকন ধান ৩১-৩২ টাকায় কিনছেন।

গত ২ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়লেও চালের দামে তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। 'এ বছর আমাদের আর চাল আমদানি করতে হবে না। কারণ আমাদের উৎপাদন ভালো।'

ধান উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতবছর বোরো মৌসুমে বন্যা ও ঝড়ের কারণে বোরো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে চালের বাজার দরে। তখন সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়।

অবশ্য, গতবছরের শেষদিক থেকে আমনের ফলন বাজারে আসতে শুরু করলে ঘুরে দাঁড়ায় চালের বাজার।

বৃষ্টিপাত কম হলেও, আমন মৌসুমে ধানের ভালো ফলনের জন্য সরকার প্রায় ৬ লাখ সেচপাম্পের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে। সেই সুবাদেই চালের দাম স্থিতিশীল হতে শুরু করে, এবছরের বোরোর ফলন তার সঙ্গে আরও সহায়ক হয়েছে।  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানায়, এবছর কৃষকেরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উৎপাদনে টান পড়েছে। কিন্তু আমাদের উৎপাদনে এর প্রভাব পড়েনি। কৃষি প্রযুক্তির কল্যাণে ও কৃষকের সহায়তায় আমরা এখন চালে উদ্বৃত্ত, এখন কোন অস্বস্তি (ঘাটতি) নেই।'

এছাড়া, সরকারের কাছে এবারে প্রায় ১৬ লাখ ২২ হাজার টন চাল ও দেড় লাখ টনের বেশি গমের মজুদ রয়েছে।

মজুত-বিরোধী কঠোর আইন

চলতি বছরের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে পাস হয়– 'খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩।

খাদ্য অধিদপ্তরের ইস্যু করা লাইসেন্স ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে অনুমোদিত পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য নির্ধারিত সময়ের বেশি মজুত করলে, এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।  

বাংলাদেশ অটো-মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারি টিবিএসকে বলেন, 'এবছর বোরো ধানের ফলন হয়েছে ভালো। একইসঙ্গে সরকার মজুতের যে আইনটি করেছে তার কারণে অনেকে এখন ধান স্টক করা থেকে সরে আসছে। এটা সরবরাহ বাড়াতে বড় ভুমিকা রাখছে। আগে গ্রামেগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী লাইসেন্সের তোয়াক্কা না করেই ধান, গম সরিষাসহ বিভিন্ন শস্য মজুত করতো, এবং সুবিধামতো সময়ে বেশি দামে বিক্রি করতো। কিন্তু, নতুন আইনের কারণে এখন ধানের পাশাপাশি গম ও সরিষার দামও কমছে।'

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.