বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের উদ্যোগ

বাংলাদেশ

20 August, 2023, 11:45 am
Last modified: 20 August, 2023, 12:03 pm
ইউনিসেফের অর্থায়নে সোশ্যাল বিহেভিয়ার চেঞ্জ (এসবিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলবে ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। 

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ফরাজি পাড়ার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী রেশমা আক্তার। ধরলা নদী পাড়ের এক দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে। নদীভাঙ্গনের মুখে বসবাস করা এই অঞ্চলে, পরিবারগুলোর বোঝা কমাতে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে।   

কিন্তু রেশমা তার বড় বোনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। রেশমার বড় বোন গত বছর এইচএসসি পাশ করেছে।

"আমাদের গ্রামে কিশোর-কিশোরীদের একটি দল আছে। সরকারি ও বেসরকারি এনজিও কর্মীদের সহায়তায়, আমরা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি। বাল্য বিয়ে হলে নানান ধরনের শারিরিক সমস্যা, বাচ্চায় নেওয়ার সময়কার ঝুঁকি, পারিবারিক কলহের মত ঘটনা ঘটতে পারে- এসব বিষয়ে মানুষকে আমরা সচেতন করার চেষ্টা করছি," জানান রেশমা।

তিনি আরও জানান, তার পরিবারও এসব বিষয় বোঝার পর তাদের দুই বোনকে পড়াশোনা করতে দিচ্ছে। 

রেশমার পরিবারের মতো এই এলাকার অনেক পরিবারই এখন বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হয়ে উঠছে। পরিবারগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে আচরণগত পরিবর্তন। জানা যায়, ইউনিসেফের অর্থায়নে 'সোশ্যাল বিহেভিয়ার চেঞ্জ' নামের এক প্রকল্প  গ্রহণের পর এলাকায় এ ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।

ইউনিসেফের অর্থায়নে সোশ্যাল বিহেভিয়ার চেঞ্জ (এসবিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলবে ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। 

প্রকল্পটি কুড়িগ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ এবং গাইবান্ধার ৬টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ৬টি উপজেলার প্রায় ১৪ লাখ উপকারভোগীদের জন্য কাজ করছে প্রকল্পটি। 

প্রকল্পের উদ্যেশ্য হলো- শিশু নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। অভিভাবক, শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং এলাকার প্রভাবশালীদের আচরণগত পরিবর্তন, বাল্যবিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়িয়ে কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।  

এই প্রকল্পের এলাকাগুলোতে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির মাধ্যমে ১২২টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানা যায়। 

যেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রকল্পটি

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এনজিওর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচারণার ফলে এই এলাকায় ধীরে ধীরে বাল্যবিবাহের প্রবণতা পাল্টে যাচ্ছে।

কুড়িগ্রাম সদরের ৯নং যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহ্বাজ আব্দুল গফুর টিবিএসকে বলেন, "নদী ভাঙ্গনের তীব্র ঝুঁকিতে থাকা এই অঞ্চলে বছরে একবার ধান হয়। এছাড়া ভুট্টা, গম, ডাল জাতীয় ফসলসহ কিছু ফসলের আবাদ হয়। দরিদ্র এই মানুষগুলোর অভাবের কারণেই অপ্রাপ্ত বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত। এই চিত্র বদলাচ্ছে, কারণ নেতিবাচক ফলাফলগুলো মানুষ জানে, সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং সামাজিক এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।" 

কুড়িগ্রাম রাজারহাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম বলেন, "১৬টি নদ-নদীবেষ্ঠিত এই জেলায় অনেকগুলো চর আছে এবং নদী ভাঙ্গনের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যার পাশাপাশি এখানকার অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী আমরা, মহিলা বিষয়ক অফিস, সমাজসেবা অফিস, উপজেলা প্রশাসন, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও বেশ কিছু এনজিও একসঙ্গে কাজ করছি।"

তিনি বলেন, "প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে নারী ও শিশু সুরক্ষা কমিটি আছে। সেই কমটিগুলো তাদের নির্ধারিত ওয়ার্ডে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি মাসে ইউনিয়ন  ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটিগুলো মিটিং করছে। এই মিটিং এর মাধ্যমে আইন ও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, যা থেকে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে এবং সোশ্যাল বিহেভিয়ারে পরিবর্তন আসছে।" 

"এর পাশাপাশি বিয়ের সাথে জড়িত কাজী, রেজিস্টার বা ইমামদেরকেও সাথে নিয়ে নানামুখী সেমিনার এবং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করা হয়েছে। যাতে করে তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা যায়," যোগ করেন তিনি। 

ইউনিসেফের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান এএইচ তৌফিক আহমেদ বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ তে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন এবং বাল্যবিবাহ রোধে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে মাল্টি-সেক্টরাল সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, "ইউনিসেফ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থিত লোকাল অ্যাডভোকেসি, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং (সক্ষমতা বৃদ্ধি) এবং কমিউনিটি এঙ্গেজমেন্টের মাধ্যমে আমরা রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে অংশীদারদের সাথে জোরালোভাবে কাজ করছি।"

দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহে শীর্ষে বাংলাদেশ 

ইউনাইটেড নেশনস পলুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ) গত ১৯ এপ্রিল 'এইট বিলিয়ন লাইভস, ইনফিনিট পসিবিলিটিজ' শিরোনামে বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে বাল্যবিবাহতে এখনও দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। 

এখানে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। বাল্যবিবাহের সার্বিক প্রভাব পড়ে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে। বাল্যবিবাহের কারণে মা ও নবজাতক মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ ঘটছে মালদ্বীপে- মাত্র ২ শতাংশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৮ শতাংশ, ভারতে ২৩ শতাংশ, ভুটানে ২৬ শতাংশ, আফগানিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.