বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে দক্ষ শ্রমিক অভিবাসন বাড়ছে, এক বছরে সর্বোচ্চ

বাংলাদেশ

18 August, 2023, 11:25 pm
Last modified: 19 August, 2023, 03:23 pm
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ১০৭ জন জন দক্ষ কর্মী যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন খাতে চাকরি পেয়েছেন, যা এক বছরের জন্য সর্বকালের সর্বোচ্চ। 

যুক্তরাজ্যে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষ করে কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী ও হসপিটালিটি কর্মী পাঠানো বেড়েছে বেশি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ১০৭ জন জন দক্ষ কর্মী যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন খাতে চাকরি পেয়েছেন, যা এক বছরের জন্য সর্বকালের সর্বোচ্চ। 

এর আগে ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৯৩ জন কর্মী নিয়োগ করেছিল।

শিল্প পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কর্মী নিয়োগ এভাবে বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে—যেমন, ব্রেক্সিটের পর ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী কর্মী গমন কমে যাওয়া, মহামারির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের ফলে দেশটির শ্রমশক্তির ক্লান্ত হয়ে পড়া এবং নথিভুক্ত হয়নি এমন কর্মী নিয়োগের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য সরকারের কঠোর অবস্থান।

তারা অবশ্য এ-ও বলেছেন যে, উৎস ও গন্তব্য উভয় দেশেই অননুমোদিত এজেন্সিগুলো এই ধারাকে পুঁজি কররে ফায়দা লুটছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়া এই এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত নিয়োগ ফি আদায় করছে।

জানতে চাইলে রিক্রুটিং এজেন্সি ওয়ার্ল্ড ভিশন ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা সরাসরি যুক্তরাজ্যে কর্মী পাঠাচ্ছি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে চাকরি জোগাড় করা বেশ কয়েকজন ব্যক্তি আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে বিএমইটি থেকে ক্লিয়ারেন্স কার্ড নিচ্ছেন। গত এক বছরে প্রায় ৪০০-৫০০ ব্যক্তি আমাদের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের চাকরির জন্য বিএমইটির কার্ড নিতে পেরেছেন।'

ফামা এয়ার সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুল মালেক বলেন, 'আমাদের ফার্ম প্রায় ২৫০-৩০০ কর্মীকে বিএমইটি থেকে ইমিগ্রেশন কার্ড সংগ্রহ করে দিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা।'

গত দেড় বছরে বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ৩০০ কেয়ারগিভার, ২৮০ জন রেস্টুরেন্ট ওয়েটার, ২৩৯ জন গৃহকর্মী, ৯৮ জন শেফ, ৮২ জন বিক্রয়কর্মী ও ৪৮ জন কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হয়েছে।

এই তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি—২ হাজার ৮২৬ জন ব্যক্তি—নিয়োগ পেয়েছেন কর্মী/শ্রমিক শ্রেণির আওতায়। এর মধ্যে ৯২২ জনকে দক্ষ শ্রমিক হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

তবে এই শ্রমিকদের প্রকৃত চাকরির ক্যাটাগরি সম্পর্কে বিএমইটি কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট তথ্য নেই।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, বিএমইটির প্রাক্কলন অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাজ্যে চাকরি পাওয়া প্রায় ৪৯ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মীই নারী।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবী এবং ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের সুপ্রিম কোর্টের অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, 'যাদের "দক্ষ কর্মী" হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, তারা মূলত কেয়ার-গিভিং ও রেস্টুরেন্ট খাতে চাকরি পান। কেউ কেউ আইটি ও ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো খাতেও প্রবেশ করেন। আইইএলটিএস-এ মাত্র চার পয়েন্ট লাগে বলে এসব পদে চাকরি পাওয়া বেশ সহজ হয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'কেয়ারগিভার পদের জন্য প্রায় ১ লাখ চাকরি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই খাতে পর্যাপ্ত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দিতে পারছে না। এই সমস্যাটির সমাধানে সরকারের আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।'

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে যে পেশাগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি ছিল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ডেভেলপার, সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যসেবা ও রেসিডেনশিয়াল কেয়ার, স্থপতি, গ্রাফিক ডিজাইনার ইত্যাদি।

চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্য সরকারের অভিবাসন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে দেশটিতে সোশ্যাল কেয়ার খাতে ৫৮ হাজার বিদেশি কর্মী যোগ হয়েছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘাটতির মুখে যুক্তরাজ্য সরকার আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ 'কেয়ার ওয়ার্কার' ও 'হোম কেয়ারার' নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের আওতায় সরবরাহকারীরা প্রথমবারের মতো এসব পদে সরাসরি বিদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা পায়। এরপরই দেশটির কর্মশক্তিতে যোগ দেওয়া বিদেশি কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে।

স্বাস্থ্য ও কেয়ারগিভার খাতে অর্ধেকেরও বেশি ভিসা দেওয়া হয়েছে ভারত (২৯ হাজার ৭২৬), নাইজেরিয়া (১৭ হাজার ৫৯৬) ও জিম্বাবুয়ের (১৭ হাজার ৪২১) কর্মীদের। এই তিন দেশ থেকে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য ও সোশ্যাল কেয়ার খাতে কাজ করতে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

স্বাস্থ্যসেবার (নার্সিংসহ) চাকরিতে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড বেতন পাওয়া যায়। আর কেয়ারগিভিং পদের চাকরিতে গড়ে বেতন শুরু হয় ২১ হাজার পাউন্ড থেকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত নভেম্বরে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হওয়া ফরিদপুরের একজন উচ্চ-দক্ষ কর্মী বলেন, 'আমি একটি লজিস্টিকস সেবা প্রদানকারী কোম্পানিতে চাকরি করি। যুক্তরাজ্যে মূলত দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বেশি। অনেকে বিভিন্ন উপায়ে দেশটিতে যেতে পারলেও, দক্ষতার ঘাটতি থাকায় তারা চ্যালেঞ্জে পড়ে যান।'

ভুয়া চাহিদা, চড়া অভিবাসন ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ

এদিকে যুক্তরাজ্যে কর্মীদের চাহিদা বেশি থাকার সুযোগ নিয়ে বেশ কয়েকটি অনিবন্ধিত এজেন্সি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা কর্মীপ্রতি ২০ লাখ টাকার বেশি আদায় করে নিচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে কৃষিকর্মী নিয়োগের অনুমতিপ্রাপ্ত যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান রিজেন্সি রিক্রুটের পরিচালক নাসিম তালুকদার টিবিএসকে বলেন, 'প্রয়োজন নেই, তারপরও কর্মী চাহিদা বেশি দেখিয়ে কর্মী নিয়োগের প্রবণতা রয়েছে। পরে এই কর্মীদের অনেকেই মিথ্যা অজুহাতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।'

'একটি চক্র মূলত অর্থের লোভে এই কাজ করছে। এটি বৈধ নিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। জালিয়াতি বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে,' বলেন তিনি।

নাসিম জানান, যুক্তরাজ্য আগামী বছর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব থেকে ৪৫ হাজার মৌসুমী কৃষিকর্মী নিয়োগ দেবে।

দুর্নীতির উদ্বেগের মধ্যে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ থেকে স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে জানিয়ে আইনজীবী মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, 'এই পরিস্থিতিতে অনিবন্ধিত এজেন্টরা প্রায় ১৮-২০ লাখ টাকায় অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়োগের চেষ্টা করছে।'

বিএমইটির ডিজি শহীদুল আলম বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো। নানা জালিয়াতির জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি কর্মীদের চাকরির সুযোগ রক্ষা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.