২ চিকিৎসক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ, ভোগান্তিতে রোগীরা

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
17 July, 2023, 03:55 pm
Last modified: 17 July, 2023, 08:00 pm
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে চিকিৎসক না থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক হাসাপাতালে রোগ পরীক্ষা করা হলেও চিকিৎসকের অভাবে রিপোর্ট পাচ্ছেন না রোগীরা। তবে অল্পসংখ্যক হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা দেশে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধের কর্মসূচি পালন করছেন চিকিৎসকেরা। এতে চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।

দুই গাইনি চিকিৎসক গ্রেপ্তারের ঘটনায় সোম ও মঙ্গলবার (১৭ ও ১৮ জুলাই) প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস সোসাইটি অভ বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। চিকিৎসকদের অন্যান্য সংগঠনও তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে।

বেশ কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগ ও ইনডোর চিকিৎসা সেবা চালু থাকলেও সেগুলোতে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ থাকছে।

ফলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে চিকিৎসক না থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক হাসপাতালে রোগ পরীক্ষা করা হলেও চিকিৎসকের অভাবে রিপোর্ট পাচ্ছেন না রোগীরা।

তবে অল্পসংখ্যক হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসেস-এর পরিচালক ডা. আরিফ মাহমুদ তাদের হাসপাতালে সব ধরনের সেবা চালু আছে জানিয়ে বলেন, 'অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের মতো বাইরের চিকিৎসকেরা আমাদের হাসপাতালে চেম্বার করেন না। আমাদের সব নিজস্ব ডাক্তার। তাই আমাদের এখানে সব ধরনের সার্ভিস চালু আছে।'

সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের রোগীর সেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) আশরাফুল্লা চৌধুরী। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসকেরা অন্যান্য সময়ের মতো দায়িত্ব পালন করছেন।'

বগুড়ার ক্রিশ্চিয়ান মিশন হাসপাতালেও ধর্মঘটেরর মাঝে চিকিৎসাসেবা চালু রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. সুপ্রতীক ঘাঘড়া।

তবে রোগীরা ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য ফোন দিলে দুই দিন চেম্বার বন্ধ থাকবে বলে জানিয়ে দিচ্ছে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেহের-এ-খোদা দ্বীপ টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে সব প্রাইভেট চেম্বার এবং অপারেশন বন্ধ রয়েছে। তবে ইনডোর চিকিৎসা সেবা ও ইমার্জেন্সি বিভাগ চালু রয়েছে। চেম্বারে ডাক্তার দেখানোর জন্য কোনো রোগী আসেননি।'

ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ম্যানেজার (বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন) এমএইচ দুলাল বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে মোট ৮৫ জন ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বার করেন। আজ সব চেম্বার বন্ধ আছে। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় ইমার্জেন্সি ও ইনডোর সার্ভিস চালু আছে।'

ঢাকার সাভারের বেসরকারি পর্যায়ের কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই আজ চেম্বার করছেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। 

সাভারের থানা স্ট্যান্ডে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ রাজু আহমেদ বলেন, আমাদের কোনো চিকিৎসকই আজ চেম্বারে আসেননি। সকাল থেকে সব রোগী ফিরে যাচ্ছেন। যেসব রোগীরা আগে থেকে সিরিয়াল নিয়ে রেখেছিলেন, আমরা তাদের ফোন করে আসতে নিষেধ করেছি।

আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, এক্সরের মতো টেস্টগুলো বন্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'অন্য কয়েকটি টেস্ট করতে পারলেও রিপোর্ট দিতে পারছি না চিকিৎসক না থাকায়।'

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে হাসপাতালটিতে স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন মো. জসিম উদ্দিন। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আশপাশের কোনো হাসপাতালেই ডাক্তার নেই। সাধারণ রোগীদের এভাবে কষ্ট দিয়ে চিকিৎসকেরা কীভাবে লাভবান হচ্ছেন জানি না, তবে এটা তাদের মোটেও উচিত হয়নি।'

রাজধানীর তেজকুনি পাড়া এলাকা থেকে সাভারের দ্বীপ ক্লিনিকে একজন গাইনি চিকিৎসককে দেখাতে আসা আরেক রোগী মনি বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এতদূর থেকে এলাম — এখন এসে দেখি ডাক্তার নেই। আমার তো আজকে সিরিয়াল নেওয়া। তাহলে আমাকে আগে থেকেই না করে দেওয়া উচিত ছিল।'

সাভারের বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের সংগঠন প্রাইভেট হসপিটাল ওনার'স অ্যাসোসিয়েশন অভ সাভার-এর সাধারণ সম্পাদক ও ল্যাব জোন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ওয়াকিলুর রহমান বলেন, 'হাসপাতালের জরুরি সেবা চালু আছে। তাছাড়া ইনডোরে যেসব রোগী ভর্তি রয়েছেন, আবাসিক চিকিৎসকেরা তাদেরকে সামলাচ্ছেন। তবে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আজ না আসায় পূর্বনির্ধারিত অপারেশনগুলো পিছিয়ে দিতে হয়েছে।'

এদিকে রাজশাহীতে চিকিৎসকেরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে ধর্মঘট পালন করছেন। সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করলেও বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা সেবা বন্ধ রেখেছেন তারা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে মেডিসিন, গাইনই, সার্জারি, অর্থোপেডিক্সসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকেরা দুপুর আড়াইটার পর থেকে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ রেখেছেন।

বগুড়ায় প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখা চিকিৎসক ডা. ফাহমিদা শিরিন নিলা জানান তিনি কেবল খুব জরুরি হলেই রোগী দেখবেন। 'আমরা চেষ্টা করি রোগী বাঁচানোর। আমরা তো জীবন দিতে পারি না,' বলেন তিনি।

বগুড়ায় প্রায় ৬০ জন গাইনি চিকিৎসক আছে জানিয়ে ডা. নিলা আরও বলেন, 'কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে ৯৯৯-এ কল করল, পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল — এটা কেমন কথা!'

গ্রেপ্তারের ভয় নিয়ে কীভাবে রোগী দেখবেন এমন মন্তব্য করে তিনি চিকিৎসকদের জন্য একটি সুরক্ষা আইন তৈরির এবং বিনা তদন্তে গ্রেপ্তার বন্ধের আহ্বান জানান।

ওজিএসবি'র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. পল্লব কুমার সেন। তিনি বলেন, 'কোনো ডাক্তার রোগীকে মারার জন্য চিকিৎসা দেয় না। সুতরাং হুট করে কোনো চিকিৎসকে গ্রেপ্তার করা ঠিক না।' এই সময়ের মধ্যে কোনো জরুরি রোগী এলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন বলে জানান তিনি।

সিলেটের ডাক্তারপাড়া খ্যাত রিকাবীবাজার এলাকার স্টেডিয়াম মার্কেটে কয়েকশ চিকিৎসকের চেম্বার থাকলেও সোমবার বিকেলে সেখানে গিয়ে বেশিরভাগ চেম্বারই বন্ধ পাওয়া যায়। কয়েকটি চেম্বার খোলা থাকলেও চিকিৎসক আসেননি। ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

সিলেটে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতালটির চিকিৎসকদেরকে।

এদিকে সারাদেশের মিড-লেভেল চিকিৎসকদের সঙ্গে আগে থেকেই কর্মবিরতিতে রয়েছেন ওসমানী হাসপাতালের মিড-লেভেল চিকিৎসকেরা। ফলে এদিন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরকে।

অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন রজব আলী। তিনি বলেন, 'ওয়ার্ডে রোগীর জায়গা হচ্ছে না — পর্যাপ্ত ডাক্তারও নেই।' অস্ত্রোপচারের শিডিউল পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'সবমিলিয়ে খুব বিপদে আছি, কী হবে বুঝতে পারছি না।'

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক এন্ড ট্রমাটোলজি বিভাগের আবাসিক সার্জন ফয়ছল আলম ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। তিনি বলেন, 'দায়িত্বপালন করতে গিয়ে যদি গ্রেপ্তার হতে হয়, তাহলে তো কোন চিকিৎসকই নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারবে না।

'আমার নিজেরও এখন একটু জটিল রোগীকে অস্ত্রােপচার করতে ভয় করে। এভাবে তো চলতে পারে না। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে চিকিৎসাজনিত অভিযোগ উঠলেই গ্রেপ্তার করা অনুচিত।'

ওজিএসবি-এর সিলেট শাখার সদস্য ডা. সুরাইয়া আফরোজ জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, 'আমরা ৯০০ জনের সেবা দিতে পারি। কিন্তু আজ দুপুর পর্যন্ত ২,৪০০ রোগী ভর্তি রয়েছেন।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.