নিরাপদ আম উৎপাদনে ‘ফ্রুটব্যাগিং’য়ে ঝুঁকছেন রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষিরা

বাংলাদেশ

20 May, 2023, 07:30 pm
Last modified: 20 May, 2023, 07:30 pm
ফ্রুটব্যাগিং হচ্ছে আমকে নিরাপদ ও বিষমুক্ত রাখার একটি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। ফ্রুটব্যাগিংয়ের আমে পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে না। ফলে কীটনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন পড়ে না। গত কয়েকবছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে আমে ফ্রুটব্যাগিং। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আমে ফ্রুটব্যাগিং করা হচ্ছে।

২০০ বিঘা জমিতে আম উৎপাদন করেন বাঘার আম চাষি ও ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম সানা। গত বছর তিনি বিভিন্ন জাতের ৫০ হাজার আমে ফ্রুটব্যাগিং করেছিলেন। ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম বিদেশে রপ্তানি ও ঢাকাসহ সারা দেশের সুপারশপে চাহিদা বেশি থাকায় এ বছর তিনি ২ লাখ আমে ফ্রুটব্যাগিং করতে চান। ইতিমধ্যে ২০ হাজার খিরসাপাত জাতীয় আমে তিনি ফ্রুটব্যাগিং করেছেন। ক্রমান্বয়ে ফজলি, আশ্বিনা ও বারি আম-৪-এ তিনি ফ্রুটব্যাগিং করবেন।

শফিকুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত বছর ২১.৬ মেট্রিক টন ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম বাঘা থেকে বিদেশে রপ্তানি করেছিলেন তিনি। এ বছর এখন পর্যন্ত যতজন বড় ক্রেতার সাথে কথা হয়েছে তারা সবাই ফ্রুটব্যাগিংয়ের আমের চাহিদা দিচ্ছেন। সেজন্য এ বছর কমপক্ষে ১ লাখ আমে ফ্রুটব্যাগিং করার চিন্তাভাবনা আছে তার।

শফিকুল বলেন,  'ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম যেমন বিদেশে রপ্তানি হয়, আবার দেশের বাজারেও তার চাহিদা বেশি। বিশেষ করে ঢাকার গুলশান, বনানী,  বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় এ আমের ব্যাপক চাহিদা থাকে। এছাড়া স্বপ্ন, অগোরা ও ইউনিমার্টসহ বিভিন্ন সুপারশপেও ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম বেশি বিক্রি হয়।'

ফ্রুটব্যাগিং করলে স্থানীয় বাজার থেকে আমের দাম কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ বেশি পাওয়া যায় বলে জানালেন শফিকুল। 'বাজারে আমের কেজি যদি ৫০ টাকা হয় তাহলে ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম ৭৫ টাকায় কেনে ঢাকার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্ন সুপারশপে আরও বেশি দামে আম বিক্রি করেন।'

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ফ্রুটব্যাগিং হচ্ছে আমকে নিরাপদ ও বিষমুক্ত রাখার একটি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। ফ্রুটব্যাগিংয়ের আমে পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে না। ফলে কীটনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন পড়ে না। এতে কীটনাশক স্প্রে করার খরচ থেকে বেঁচে যান কৃষকরা। তবে ফ্রুটব্যাগিং করা হয় সাধারণত দেরিতে যেসব জাতের আম বাজারে ওঠে, সেগুলোতে। বিশেষ করে ফজলি, আশ্বিনা ও বারি আম-৪-এ ফ্রুটব্যাগিং বেশি করা হয়ে থাকে। এসব আম বাজারে দেরিতে উঠায় পোকামাকড়ের আক্রমণ ও বৃষ্টিপাত থেকে রক্ষা করতে এসব আমে ফ্রুটব্যাগিং বেশি করা হয়। তবে দাম বেশি পাওয়ার আশায় এখন খিরসাপাত, ল্যাংড়া ও আম্রপালি আমেও ফ্রুটব্যাগিং করা হচ্ছে। ফ্রুটব্যাগিং করলে আমের রং নষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

গত কয়েকবছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে আমে ফ্রুটব্যাগিং। রাজশাহী অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আমে ফ্রুটব্যাগিং করা হচ্ছে।

গত পাঁচবছর ধরে আমে ফ্রুটব্যাগিং করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের রুবেল আলী। তিনি বলেন, 'ইতিমধ্যে আমরা ৯৫ হাজার আমে ফ্রুটব্যাগিং করেছি। আরও ৯৫ হাজার আমে ফ্রুটব্যাগিং করব। 

'আমরা প্রধানত ফজলি ও আশ্বিনা আমে ফ্রুটব্যাগিং করি। ফ্রুটব্যাগিং করলে কীটনাশক খরচ কম লাগে। আম ফাটা ও পচা কম হয়।'

রুবেল বলেন, আমের গাছে মুকুল ধরা থেকে আম নামানো পর্যন্ত ১৭ থেকে ১৮ বার স্প্রে করতে হয়। আর ফ্রুটব্যাগিং করলে ছয় থেকে সাতবার স্প্রে করলেই চলে। 

তিনি জানান, এ পর্যন্ত যেসব আমে ফ্রুটব্যাগিং করা হয়েছে সেখানে কীটনাশক স্প্রে করতে হয়েছে ছয়বার। এই ছয় দফা কীটনাশক স্প্রে করতে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে প্রায় ৬ লাখ টাকা বেঁচে গেছে তার।

ঢাকার বিভিন্ন সুপারশপে চাহিদামতো প্রতিদিন আম সরবরাহ করে 'লেজার ইনোসেন্ট' নামের আম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। লেজার ইনোসেন্টের ম্যানেজার গোলাম রাব্বানী বলেন, 'ব্যাগিংয়ের আমে কোনো স্পট থাকে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রং ভালো থাকে। এজন্য ঢাকার গুলশান, বারিধারাসহ বিভিন্ন ভিআইপি এলাকায় এ ধরনের আমের চাহিদা বেশি থাকে। এছাড়া সুপারশপগুলোতেও ব্যাগিংয়ের আমের চাহিদা বেশি। কারণ আমাদের দেশে বসবাসরত বিদেশিরা ফ্রুটব্যাগিংয়ের আম বেশি পছন্দ করেন।'

ছবি: টিবিএস

তবে গত দুই বছরে ফ্রুটব্যাগিংয়ের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। বাঘার আমচাষি শফিকুল ইসলাম সানা বলেন, 'এ বছর আমি চীন থেকে ব্যাগ নিয়ে এসেছি। খরচ পড়ছে ব্যাগপ্রতি সাড়ে ৪ টাকা। আবার আমে ব্যাগ পরানোর জন্য কৃষককে প্রতি ব্যাগের এক টাকা করে দিতে হয়। অথচ গত দুই বছর আগেও ভালো মানের ব্যাগের দাম ছিলো প্রতি ব্যাগ আড়াই টাকা।'

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ব্যাপক ফ্রুটব্যাগিংয়ের চাহিদা বেড়েছে। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ থেকে ৪ কোটি পিস আমে ফ্রুটব্যাগিং করা হবে।

তিনি বলেন,  'একজন আম চাষি জানিয়েছেন, তার আম বাগানে একবার কীটনাশক স্প্রে করতে ৭০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ফ্রুটব্যাগিং না করলে গাছে মুকুল আসা থেকে শুরু করে আম নামানো পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গাছে কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। সেজন্য তিনি তার বাগানের আমে এ বছর ফ্রুটব্যাগিং করেছেন। ফ্রুটব্যাগিংয়ের দাম বেশি হলেও ভালো মানের ফ্রুটব্যাগিং একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। ফলে খরচ কমে আসে। কারণ ফ্রুটব্যাগিং করার আগে শুধু একবার স্প্রে করলেই হয়। আর কোনো স্প্রে করতে হয় না।'

ফ্রুটব্যাগিং ব্যবহারের বিষয়ে পলাশ সরকার বলেন, 'যারা ফ্রুটব্যাগিং করবেন তারা অবশ্যই ফ্রুটব্যাগিং করার আগে আমে একবার কীটনাশক স্প্রে করে নিয়ে তারপর ফ্রুটব্যাগিং করবেন। 

বিদেশে রপ্তানি

নওগাঁর সাপাহারের সোহেল রানা ২০১৫ সাল থেকে আম চাষ শুরু করেন। এ বছর তিনি ১৫০ বিঘা জমিতে আম্রপালি, বারি আম-৪, গৌড়মতি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, কাটিমনসহ বিভিন্ন জাতের আমের আবাদ করছেন। তিনি গত বছর আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, গৌড়মতি ও বারি আম-৪ এ ৩ লাখ ফ্রুটব্যাগিং করেছিলেন।

সোহেল জানান, গত দুই বছর ধরে তিনি আম বিদেশে রপ্তানি করছেন। গতবছরও তিনি ২৫ মেট্রিক টন আম ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পাঠিয়েছিলেন। এবছর দ্বিগুণ আম পাঠানোর লক্ষ্য রয়েছে তার।

তিনি জানান, থার্ড পার্টির মাধ্যমে আমগুলো বিদেশে পাঠাতে হয়। নওগাঁর আমের মান ভালো হওয়ায় অনেকে বাজার থেকে কিনেও বিদেশে পাঠান, যা আইনসঙ্গত না। সরকারিভাবে চাষিদের কাছ থেকে আম কিনে বিদেশে রপ্তানি করা গেলে দেশের প্রকৃত আমচা ষিরা লাভবান হবেন বলে মনে করেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকার ইসমাইল খানও গত বছর ১০০ মেট্রিক টন খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি ও আম্রপালি আম বিদেশে রপ্তানি করেছিলেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'থার্ড পার্টির মাধ্যমে বিক্রি করায় দাম কম পাই। আবার রপ্তানির জন্য সরকার থেকে যে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয় সেটাও পাই না। যারা রপ্তানি করে তারা পায়। এজন্য আম যেখানে বেশি উৎপাদন হয় সেখানে ক্রয়কেন্দ্র তৈরি করে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হলে ভালো হতো।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ জানান, গত বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে ৯০ হাজার ৮৯৪ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ করে উৎপাদন হয়েছিলো ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন। এ বছর  ৯২ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ০৭ হাজার ৮৮৩ মেট্রিক টন।

শামছুল বলেন, 'গত বছর ২২৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল। আমরা আশা করছি এ বছর ১ হাজারমেট্রিক টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে রাজশাহী থেকে ইতালিতে গুটি জাতের চৌষা আম ৩০০ কেজি রপ্তানি হয়েছে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.