বিলেত প্রবাসীরা আগের মতো আসেন না, সিলেট জুড়ে ঈদের বাজারে নেই সেই জৌলুস

বাংলাদেশ

21 April, 2023, 01:20 pm
Last modified: 21 April, 2023, 01:37 pm
ঈদের অনুষ্ঠান এবং শীতকালেই সাধারণত প্রবাসীদের ঢল নামত সিলেটে। প্রবাসীদের দেশে না আসার কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে।

লন্ডন (ইংল্যান্ড) প্রবাসী দেশে এসেছেন ঈদ করতে, ঈদের বাজারে নিয়ে এসেছেন আত্মীয়স্বজন সবাইকে। ১ থেকে ১০ লাখ টাকার বাজার করছেন সবার জন্য। আত্মীয়স্বজনের মুখেও হাসি। দল বেঁধে বাজার করে ফিরছেন বা ঘুরছেন এক মার্কেট থেকে আরেক মার্কেটে। পথে পথে ভিক্ষুকদের আবদার মেটাতে পকেট থেকে বের করে দিচ্ছেন নতুন নোট কখনোবা পাউন্ড। এই চিত্র একসময় সিলেট বিভাগের বড় বড় মার্কেটে দেখা গেলেও এখন আর নেই। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসীদের তৃতীয়/চতুর্থ প্রজন্ম চলছে যাদের জন্ম হয়েছে বিলেতে, বেড়ে ওঠাও বিলেতে, ফলে দেশের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো।

সরেজমিনে মৌলভীবাজারের বেশ কিছু বিপণিবিতানের দোকানিদের সাথে আলাপ করে এমন তথ্য জানা যায়। তারা মনে করছেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেরই মাতৃভূমি নিয়ে সেরকম টান না থাকায় বা আত্মীয়স্বজনদের প্রতি পূর্বজদের মতো যোগাযোগ না থাকায় তারা এখন আর ঈদের সময় দেশে ছুটে আসেন না।

প্রবাসীদের দেশে না আসার কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে। ঈদের অনুষ্ঠান এবং শীতকালেই সাধারণত প্রবাসীদের ঢল নামত সিলেটে। গত কয়েক বছরে এই চিত্র বদলাতে থাকলেও কোভিডের পর একেবারে যেন দেশবিমুখ প্রবাসীরা। 

মৌলভীবাজারের এমবি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পরিচালক নুরুল ইসলাম কামরান জানান, 'প্রবাসীরা দেশে না আসায় আমাদের বিক্রি কমেছে ৫০% শতাংশ। একজন লন্ডনী (বিলেত প্রবাসী) যখন দেশে আসতেন তখন সাথে গরিব এলাকাবাসীসহ আত্মীয়স্বজনদের নিয়েও মার্কেটে আসতেন বা তাদের টাকা দিতেন ঈদের বাজারের জন্য। ২ থেকে ১০ লাখ টাকার মালামাল ক্রয় করতেন। এখন তারা দেশে আসছেন না ফলে আমাদের ব্যবসা কমেছে ৫০ শতাংশের উপরে। শুধু যে আমাদের কমেছে তা না, স্থানীয় অর্থনীতির চাকায় বড় ধাক্কা খেয়েছে। কারণ তারা দেশে আসলে গাড়ী রিজার্ভ করতেন, সাথে মানুষ রাখতেন যাদেরকে সরাসরি বেতন না দিলেও বিভিন্নভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন। তাদের অপেক্ষায় থাকা গরীব এলাকাবাসী বা আত্মীয়স্বজনদেরও তারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। ফলে বিভিন্ন সেক্টর লাভবান হতো।' 

এই বিষয়ে ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিলেত প্রবাসী মুনজের আহমেদ চৌধুরীর মত, বর্তমানে তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম চলছে, এদের দেশের প্রতি এত টান নেই। তারা দেশে যেতে চায়না বরং তাদের পূর্বপু্রুষের যে সম্পদ দেশে আছে তা বিক্রি করে এখানে এনে বিনিয়োগ করতে চায়। এটা স্বাভাবিক বিষয় কারণ তারা এখানেই বড় হয়েছে, এই পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে, দেশের সাথে যোগাযোগও কম।

দীর্ঘদিন পর লন্ডন শহর থেকে এই ঈদে দেশে ফিরেছেন সালেহ আহমদ। তিনি থাকেন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে, এর আগে আরও দুইবার এসে পরিবার, স্বজনদের সাথে ঈদ কাটিয়ে গেছেন। এবছরও ঈদের আগে আগেই দেশে চলে এসেছেন পরিবার নিয়ে ঈদ করতে। এ ব্যাপারে আলাপ করলে তিনি বলেন, 'আমরা বিদেশে বসে যতো পরিশ্রমই করি, যতো টাকাই কামাই করি না কেন আমাদের মন পড়ে থাকে দেশের মাটিতে; এইটা নাড়ির টান। এই নাড়ির টানেই প্রতিবছর ঈদের আগে বাড়ি আসি। পরিবার, স্বজনদের নিয়ে কেনাকাটা করি। তবে নাতিরা আসতে চায়না দেখে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় না। তারা সেখানেই ঈদ করে খুশি।'

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কেন আপনাদের মতো ঈদে পরিবার-পরিজনদের কাছে আসে না—জানতে চাইলে এই প্রবাসী বলেন, 'এটা ঠিক নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন আর দেশে আসে না ঈদের আগে। অনেকেই আসেন। তবে পরিমাণটা কমে যাচ্ছে। এর কারণ আমরা যেভাবে পরিবারকে নিয়ে ঈদ কাটাতে উন্মুখ থাকি নতুন প্রজন্মে সেই আবেগটা দেখা যায় না। আবার নতুন প্রজন্মের সাথে নিজের নাড়ির সম্পর্কের পরিচয়হীনতাও একটা কারণ। অনেকেই আছেন যারা দেশে তাদের আত্মীস্বজনদের চেনেন না। তাই তারা ঈদের সময় দেশেও আসেন না। অনেকে পুরো পরিবার নিয়ে বিদেশে থাকেন বলে তারাও ঈদে দেশে আসেন না।'

এদিকে এসব প্রবাসীরা ঈদের আগে দেশে না আসায় আগের মতো বেচাবিক্রিও করতে পারছে না নামীদামি বিপণিবিতানগুলো। 

মৌলভীবাজারের কয়েকটি বড় শপিং সেন্টারে আলাপ করলে জানা যায়, প্রতি ঈদের বাজারেই তাদের কিছু নিয়মিত প্রবাসী ক্রেতা আসেন। তারা একবারে কয়েক লাখ টাকার কেনাকাটা করেন। কিন্তু এসব এখন কমে গেছে আগের থেকে। প্রবাসীরা আগের মতো দেশে আসছেন না। পুরোনো প্রবাসী ক্রেতাদের কেউ কেউ মারা গেছেন। নতুন প্রজন্মের যারা আছেন তারা এখন দেশেই আসেন না ঈদের আগে। আসলেও তাদের বাপ-চাচাদের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের বাজার করতে আসেন না।

মৌলভীবাজারে বিদেশী/প্রবাসী ক্রেতাদের নজর কাড়তে দারুণ সব কালেকশন প্রদর্শনী করে রেখেছেন দোকানিরা। শপিং সেন্টারগুলো আশা করছে ঈদ যতো ঘনিয়ে আসবে ততো বাড়তে পারে প্রবাসী ক্রেতার সংখ্যা।

ক্রেতাদের সন্তোষজনক আগমন না থাকায় হতাশায় আছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের থান কাপড়ের ব্যবসায়ীরাও।

চলতি বছর থান কাপড়ের বিক্রি অনেক কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ী অনিমেষ দেব। তিনি বলেন, 'বেশি বিক্রি ও লাভের আশায় অধিক টাকা বিনিয়োগ করলাম। কিন্তু সে তুলনায় বিক্রি কম।'

শহরের মধ্যে থান কাপড়সহ অন্যান্য কাপড়ের ছোট ও মাঝারি তিনটি দোকান রয়েছে রিপনের। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, 'প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতা পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় আছি।'

কথা হয় কাপড় সেলাইয়ের দোকান মালিক হাসান আহমদ ও কারিগর আসগর মিয়ার সঙ্গে। তারা জানান, অন্য বছরের তুলনায় কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার কম আসছে।

মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ডা. আব্দুল আহাদ জানান, 'আগের মত প্রবাসীরা দেশে আসেনা। আমার নিজেরই অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে তাদের বর্তমান প্রজন্ম খুবই বাস্তববাদী। তাদের কাছে পারিবারিক আবেগের মূল্য কম। তারা বিলেতেই ভাল আছে, সেখানেই ভাল কিছু করতে চায়। দেশে বিনিয়োগ করতেও যেমন ঝুঁকি নিতে চায় না, তেমনি দেশে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে সময় কাটাতেও তারা এত আগ্রহী না। তাদের এই না আসার ফলে সিলেট বিভাগের সব জেলার অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে।'

একই সাথে তিনি যোগ করেন, 'নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অধিক দামের ফলে বেশিরভাগ মানুষ অর্থসংকটে রয়েছেন। এর প্রভাব ঈদ বাজারে পড়েছে। ব্যবসা যত কম হবে, ব্যবসায়ীরা তত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.