২০২৪ সালের শেষে আট লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ শুরু
২০২৪ সালের শেষ দিকে (অথবা ২০২৫ সালের শুরুতেই) দেশের প্রধান অর্থনৈতিক লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে আট লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু করতে চায় সরকার। একইসঙ্গে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে গুরুত্ব দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজও শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কাজে তৎপরতা বেড়েছে সরকারি সংস্থাগুলোর।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নির্মাণ কাজে যাওয়ার আগে এই দুই মহাসড়কের উন্নয়নে যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষ করে অর্থায়ন, নকশা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে রাখার লক্ষ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে এই মেগা প্রকল্প রাখতে চায় সরকার। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে যত দ্রুত সম্ভব দুই প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে রাখতে কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ কারণে এই দুই জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়নের প্রস্তুতিমূলক কাজে তৎপর হয়ে উঠেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৫টি স্থানে বাইপাস/উড়ালসড়ক নির্মাণে জাইকার সঙ্গে চলতি মাসে ঋণচুক্তি হতে যাচ্ছে। এছাড়া আলাদা একটি প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণে ঋণ প্রস্তাব আগামী দুই/এক মাসের মধ্যে জাইকার কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আট লেনে উন্নয়নের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা তৈরিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার কাজও আগামী এক মাসের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রাথমিক হিসাবে অনুযায়ী, এই দুই জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়নে মোট ব্যয় হবে ৯৫,৬৫০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪টি এলাকায় বাইপাস সড়ক এবং আরেকটি এলাকায় উড়াল বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজ আগামী অর্থবছরে শুরু হবে। বাইপাস তৈরি হবে পটিয়া, দোহাজারি, কেরানীহাট, আমিরাবাদ এবং চকরিয়ায়। কেরানীহাটে বাইপাসের পরিবর্তে নির্মাণ করা হবে উড়াল সড়ক।
এই প্রকল্পে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) ৪,৫৩৩ কোটি টাকা ঋণ দেবে। এ মাসের শেষের দিকে জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই হবে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব একেএম শাহাবুদ্দিন।
এই প্রকল্পের সমীক্ষার কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ কাজ করছে জাইকা। একইসঙ্গে চলছে মূল প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির কাজ। ডিপিপি অনুমোদনের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে বলে জানান সড়ক ও জনপথ বিভাগের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য।
এই প্রকল্পের সঙ্গে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চার লেনের উন্নয়নে আরেকটি প্রকল্পের প্রস্ততিমূলক কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ফেব্রুয়ারিতে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) নীতিগত অনুমোদনের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়কের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আতাউর রহমান বলেন, 'আগামী এক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেনের উন্নয়ন কাজের প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার করার লক্ষ্য রয়েছে। এই উদ্দেশ্যে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন যদি মনে করে প্রকল্পটি উন্নয়ন সহযোগীর অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে, সেক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করতে পিডিপিপি ইআরডির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে পাঠানো হবে।'
এই মহাসড়কে চার লেনের উন্নয়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনের উন্নয়ন কাজ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল সরকার। কিন্ত দ্রুত বাস্তবায়নের স্বার্থে এই প্রকল্প এখন পিপিপিতে না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরো জানান, এখন এই প্রকল্পটি সরকারি অর্থায়ন অথবা উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারি তহবিলের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা গেলে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। বৈদেশিক ঋণের বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রক্রিয়াগত কারণে প্রকল্প শুরু করতে সময় লাগতে পারে। সরকারি তহবিলের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হলে নতুন করে সমীক্ষা করতে হবে না। এই প্রকল্প অর্থায়নে জাইকার আগ্রহ রয়েছে। সেক্ষেত্রে জাইকা নতুন করে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করবে।
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়ন প্রকল্পের পিডিপিপির ওপর সভা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৬ মার্চ। ওই সময় এই প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেনে উন্নয়নের প্রথম সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৫ সালে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগও ২০২১ সালে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন করা হবে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সমন্বয় করে আগামী তিন বছরের মধ্যে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৬৯ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের এখন ১১০ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করতে হবে। কারণ বহদ্দারহাট থেকে শিকলবাহা পর্যন্ত আট কিলোমিটার ইতোমধ্যে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার থেকে বাঁকখালী পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারও চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে আগামী বছর থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রকল্পের আওতায় চারটি স্থানে মোট ২৪ কিলোমিটার বাইপাস চার লেনের সড়ক হবে। আবার জাইকার অর্থায়নে চলমান আরেকটি প্রকল্পের আওতায় চারটি সেতু ও সংযোগ সড়কসহ মোট ৫ কিলোমিটার সড়কের চার লেনের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেনে উন্নয়নে পিডিপিপি আপাতত ফেরত দেওয়া হয়েছে। কারণ কয়েক বছর আগের একটি সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। কাছাকাছি সময়ের সমীক্ষা ছাড়া ব্যয় প্রাক্কলন সঠিকভাবে উঠে আসে না। ফলে সঙ্গে বিশদ বিবরণ ও সমীক্ষা অনুযায়ী পুনরায় পিডিপিপি পাঠাতে বলা হয়েছে।
এদিকে আগামী এক মাসের মধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক আট লেনে উন্নয়নে সমীক্ষা ও নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগের কাজ শেষ হবে। এরপর পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ১৮ মাসের মধ্যে নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ করবে। এর আগেই অর্থায়নসহ মূল প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের কাজ শেষ করতে লক্ষ্য রয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে ২২৯ কিলোমিটারের ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ককে তিনটি ভাগ করে আলাদা আলাদা তিনটি পিডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ অংশে ৩৮ কিলোমিটার, কুমিল্লা-ফেনী অংশে ১২৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম অংশে ৬৯ কিলোমিটার ধরে পিডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। ২২৯ কিলোমিটার সড়কের কোথাও চার লেন, আবার কোথাও ছয় লেনে উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩,১৫০ কোটি টাকা।
সওজ'র কর্মকর্তারা জানান, একাধিক উন্নয়ন সহযোগীকে যুক্ত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তিনটি আলাদা অংশে ভাগ করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক টিবিএসকে জানান, জাইকার অর্থায়নে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৫টি স্থানে বাইপাস ও উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে জাপান। এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতেও অর্থায়নে আগ্রহ জানিয়েছে দেশটি।
তিনি আরো জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেনে উন্নীতকরণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করবে বলে জানিয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক: এআইআইবিও আসতে পারে। ফলে এই দুই মহাসড়ককের উন্নয়নে অর্থায়নে পেতে কোনো সমস্যা হবে না। এখন দ্রুত প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করাই প্রধান লক্ষ্য।