অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত সিলেট নগরীর একমাত্র গণপরিবহন সেবা
সিলেট নগরবাসীর যাতায়াত সহজ করতে ২০০৮ সালে শহরে চালু হয়েছিল 'টাউন বাস' সার্ভিস। তবে স্থানীয়দের মতে, ৩১টি মিনিবাস নিয়ে চালু হওয়া ওই পরিষেবা চরম অব্যবস্থাপনা এবং লোকসানের কারণে মাত্র ছয় বছরের মাথায় ২০১৪ সালেই বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর সিলেটবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে ২০১৯ সালে চালু হয় 'নগর এক্সপ্রেস'। যাত্রীসেবার নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে চালু হয় এই বাস সার্ভিস। তবে তিন বছরেও প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো অব্যবস্থাপনা আর ভোগান্তি বেড়েছে। এতে যাত্রীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ফলে সংকটে পড়েছে এই পরিষেবাও।
জানা যায়, সংকট দূর করতে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে ২১টি বাস নিয়ে চালু হয় নগর এক্সপ্রেস।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলী আকবর চৌধুরী বলেন, নগর এক্সপ্রেস পরিষেবাটি সিটি কর্পোরেশনের নয়। নগরবাসীকে ভোগান্তিবিহীন পরিবহন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন একটি বাস মালিক গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সেবা চালু করেছে।
"তবে এর লাভ-লোকসান বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমরা জড়িত নই। সিটি কর্পোরেশন শুধু রোড ম্যাপ করে দিয়েছে এবং সমন্বয় করে থাকে," বলেন তিনি।
গণপরিবহন না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় সিলেট নগরের যাত্রীদের। রিকশা-অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা নগরের নিত্যদিনের চিত্র। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় নারী যাত্রীদের। অটোরিকশায় করে যাতায়াতে অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকারও হতে হয় তাদের।
এসব সমস্যা সমাধানেই ব্যাপক প্রতিশ্রুতি নিয়ে চালু হয়েছিল নগর এক্সপ্রেস।
শুরুতে সিটি কর্পোরেশন বলেছিল, প্রতিটি বাসে থাকবে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা। বাসের ভেতরে থাকবে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ও ই-টিকিটের ব্যবস্থা। আর নারীদের জন্য থাকবে আলাদা একটি বাস, যার চালক এবং সহযোগীও হবেন নারী। এছাড়া, স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্যও আলাদা তিনটি বাস থাকবে।
তবে, তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এসবের কোনোটিই বাস্তবে দেখা মেলেনি।
যাত্রীদের উঠানামার জন্য নগরের বিভিন্ন এলাকায় আলাদা যাত্রী ছাউনি করা হবে বলেও শুরুতে আশ্বাস দিয়েছিলেন সিলেট সিটি মেয়র। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি যাত্রী ছাউনিও নির্মিত হয়নি। বাসগুলোর জন্য নেই নির্দিষ্ট কোনো স্ট্যান্ডও। ফলে রাস্তাতেই যাত্রীদের উঠা নামা করানো হয়।
নগর এক্সপ্রেসের নাজুক অবস্থা সম্পর্কে জানতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সময়ের সাথে সাথে পরিষেবার মান খারাপ হতে থাকায়, সিটি সার্ভিস এখন যাত্রী আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বাস মালিকরাও পড়েছেন লোকসানে।
নগর এক্সপেস মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, নিটল টাটা গ্রুপের কাছ থেকে ছোট আকারের এই বাসগুলো কিনে নগর এক্সপ্রেসের কার্যক্রম শুরু হয়। ৪১টি বাস নিয়ে এই সেবা চালু হওয়ার কথা থাকলেও চালু হয় ২১টি বাস নিয়ে। তবে এখন এই সংখ্যা কমে এসেছে ১২টিতে। আশানুরূপ ব্যবসা করতে না পারায় হতাশ বাস মালিকরাও।
সিটি বাস মালিক গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হয় নগর এক্সপ্রেস। এই গ্রুপের আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মখলিছুর রহমান কামরান।
তিনি জানান, কয়েকটি বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিলো। কিছুদিন পর এসব চুরি হয়ে যায়। এরপর আর বাকিগুলোতে আর লাগানো হয়নি।
বাস পরিচালনায় কিছু বিশৃঙ্খলা রয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, "এটি এখন পর্যন্ত একটি লোকসানী প্রকল্প। যে উৎসাহ এবং প্রত্যাশা নিয়ে নগর এক্সপেস চালু করা হয়েছিল, ভালো ব্যবসা না হওয়ায় তাতে ভাটা পড়েছে। এখন বাস মালিকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।"
গত ১৭ জানুয়ারি দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রী তুলছে নগর এক্সপ্রেসের ৩টি বাস। তবে বাসে উঠতে যাত্রীদের তেমন আগ্রহ নেই। একটি বাসের ভেতরে গিয়ে যায় যায়, বেশিরভাগ সিটই ভাঙাচোরা ও ময়লা। ভাড়া নিয়ে এক যাত্রীর সঙ্গে চালকের সহযোগীকে বাকবিতণ্ডায় জড়াতেও দেখা যায় এ সময়।
এই বাসে থাকা আরিফ আহমদ নামের এক যাত্রী বলেন, বাস কখন আসে কখন যায়, এসবের কোনো ঠিক নেই। যাত্রীদের উঠানামা করানোরও কোনো নিয়ম নেই। যেকোন জায়গায় থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করানো হয়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে।
তিনি বলেন, "একান্ত বাধ্য না হলে এসব বাসে উঠি না।"
এই বাসের চালক সাইদুল ইসলাম বলেন, "বাসের সিট ভাঙাচোরা, ফ্যান চলে না। এগুলো নিয়ে যাত্রীরা প্রতিদিনই ঝামেলা করেন। আমরাও কর্তৃপক্ষকে জানাই। কিন্তু তারা মেরামত করে না দিলে আমাদের তো কিছু করার নেই।"
তিনি বলেন, বাস সার্ভিস শুরুর পর প্রথমদিকে অনেক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এখন যাত্রী কমে গেছে। ফলে বাস মালিকরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
সেবার মান না বাড়ালে ও ব্যবস্থাপনা উন্নত না হলে নগর এক্সপ্রেসও হারিয়ে যাবে উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণপরিবহন না থাকা সিলেটের একটি বড় সমস্যা। সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে গণপরিবহন সেবা চালু করা খুবই ভালো উদ্যোগ ছিল।
"কিন্তু চালু করার পর ব্যবস্থাপনা ও সেবার মানের দিকে তারা খেয়াল রাখেননি। চালুর সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোও পূরণ করেননি। অব্যবস্থাপনার কারণে একটি ভালো উদ্যোগ এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে," যোগ করেন তিনি।