বড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ১০%-এর বেশি পুঁজি হারিয়েছন বিনিয়োগকারীরা
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর শীর্ষ-১৫ বাজার মূলধনের (লার্জ ক্যাপিটাল) বেশিরভাগ কোম্পানি থেকেই ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল গেইন বা রিটার্ন পাননি। কারণ ওই বছর শীর্ষ ১৫ কোম্পানির শেয়ার গড়ে ১০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।
অথচ ২০২২ সালে ছোট এবং মাঝারি মূলধনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা স্বল্প মেয়াদে কয়েকগুণ বেশি ক্যাপিটাল গেইন পেয়েছেন। তাই ২০২২ সালজুড়ে ছোট মূলধনের কোম্পানির রাজত্ব থাকায় একে 'জুয়ার' বছর বলে অভিহিত করছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা।
২০২২ সালে শেয়ারবাজারের ওপর করা সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস এবং লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের দুটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাজার মূলধন (মার্কেট ক্যাপিটাল) এবং লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড) প্রদানের হারের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে টেলিকম খাতের গ্রামীণফোন। অথচ ২০২২ সালে কোম্পানিটির শেয়ার দর ১৮ শতাংশ কমেছে। অপরদিকে, ছোট মূলধনের কোম্পানি ইমাম বাটনের শেয়ার দর ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ কোম্পানিটি বছরের পর বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যালংশই দিচ্ছে না।
এ বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ দ্য বিজিনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অল্প সময়ে বেশি ক্যাপিটাল গেইন বা মুনাফার লোভে বিনিয়োগকারীরা ছোট এবং মাঝারি মূলধনের কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন বেশি। কারণ এসব শেয়ারের দর সহজে গ্যাম্বলিং (কারসাজি) করে বাড়ানো যায়।"
"আরো দুঃখের বিষয় হলো, এসব শেয়ারেই মার্জিন ঋণ বিতরণ বেশি হয়েছে। তাই (শেয়ারবাজারে) ২০২২ সালটিকে জুয়া খেলার বছর বলা যায়। অথচ গত বছরের নভেম্বরের পর থেকে দেখা গেছে, এই শেয়ারগুলোরই দর পতন সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। আর বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছেন এগুলোতে বিনিয়োগ করে।"
তিনি বলেন, "বড় মূলধনের কোম্পানিতে সহজে কারসাজি করে শেয়ার দর বাড়ানো যায় না। তাই গ্যাম্বলাররা (যারা কারসাজি করেন) এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে না। কারণ এসব শেয়ারের দর বাড়াতে গেলে অনেক বিনিয়োগ এবং সময়ের প্রয়োজন হয়। এতো ধৈর্য্য তাদের নেই।"
"শীর্ষ ১৫ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের মূলধন ২০২২ সালে কিছুটা কমেছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ প্রদানের হার অনেক বেশি। আর সেটি দিয়ে বিনিয়োগকারীরা এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত দীর্ঘ মেয়াদে এই বড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা।"
আবু আহমেদ আরও বলেন, "আমাদের দেশে বড় বাজার মূলধনের কোম্পানিগুলো নিজ নিজ সেক্টরেও শীর্ষ কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা করছে। তালিকাভুক্ত অন্য যেকোনো কোম্পানির তুলনায় তাদের লভ্যাংশ প্রদানের হার বেশি। আর এ ধরনের কোম্পানি আরও বেশি তালিকাভুক্ত হলে বাজারে শৃঙ্খলা এবং ভারসাম্য বজায় থাকবে। যারা গুজবে কান দেন না, তারাই লভ্যাংশ প্রদানের হার দেখে বিনিয়োগ করেন। আর বছর শেষে তারাই লাভে থাকেন।"
সব সূচকে ভালো থাকা সত্ত্বেও এই বড় মূলধনের কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "দেশের অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শেয়ার বাজারে মন্দাভাব চলছে। তারই জেরে এমন পতন। তবে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীদের যে ক্যাপিটাল এরোশন বা মূলধন ক্ষয় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছোট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে।"
বড় কোম্পানির রিটার্ন
ডিএসই'র মোট মার্কেট ক্যাপিটাল বা বাজার মূলধন ৭.৬০ লাখ কোটি টাকা। এর প্রায় ৪৭ শতাংশ শীর্ষ ১৫টি কোম্পানির দখলে রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি কোম্পানি বহুজাতিক।
এই ১৫টি কোম্পানির মধ্যে শুধু বিকন ফার্মা এবং ম্যারিকো থেকে রিটার্ন পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০২২ সালে বিকন ফার্মা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ রিটার্ন বা ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে। আর ম্যারকো থেকে হয়েছে ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর শেয়ার থেকে। ২০২২ সালে আর্থিক খাতের এ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা ২৬ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন।
এছাড়া, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ২৫ শতাংশ, বেক্সিমকো ফার্মা থেকে ২৪ শতাংশ, বেক্সিমকো থেকে ২২ শতাংশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো থেকে ১৮ শতাংশ, গ্রামীণফোন থেকে ১৮ শতাংশ, রবি থেকে ১৩ শতাংশ, লাফার্জহোলসিম থেকে ৯ শতাংশ, ওয়াল্টন থেকে ৯ শতাংশ, ইউনাইটেড পাওয়ার থেকে ৪ শতাংশ, বার্জার পেইন্টস থেকে ২ শতাংশ, স্কয়ার ফার্মা থেকে ২ শতাংশ এবং রেনাটা থেকে ১ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
লভ্যাংশ প্রদানের হার
শীর্ষ ১৫ বাজার মূলধনের কোম্পানির মধ্যে গ্রামীণফোন শেয়ারের বাজার দরের বিপরীতে ৭.১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে শীর্ষে রয়েছে। কোম্পানিটি ২০২১ সালে ২৫০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড এবং ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসের হিসাব পর্যন্ত ১২৫ শতাংশ ইন্টারিম ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে।
এছাড়া, গত বছর টেলিকম খাতের রেগুলেটর গ্রামীণফোনের নতুন সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক কমে গেলেও ব্যবসায় এখনও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। যদিও চলতি বছর এই নিষধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
লভ্যাংশ প্রদানের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার। কোম্পানিটির লভ্যাংশ প্রদানের হার ৬.৮৪ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতের এই কোম্পানি গেল বছর ৩০ জুন, সমাপ্ত হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের ১৭০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। যদিও জ্বালানি তেল এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কমেছে।
লভ্যাংশ প্রদানের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে রয়েছে স্কয়ার ফার্মা (৪.৬১ শতাংশ), এরপর ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো (৪.৩৩ শতাংশ), লাফার্জহোলসিম (৩.৫২ শতাংশ), ম্যারিকো (৩.৪ শতাংশ), বেক্সিমকো (২.৩১ শতাংশ), ওয়াল্টন (২.২৯ শতাংশ), বার্জার (২.২৮ শতাংশ), বেক্সিমকো ফার্মা (২.২৬ শতাংশ), রবি (১.৪৫ শতাংশ), ব্র্যাক ব্যাংক (১.৩৬ শতাংশ), আইসিবি (১.০৮ শতাংশ), রেনাটা (১.০৪ শতাংশ), এবং এরপরে রয়েছে বিকন ফার্মা (০.৬২ শতাংশ)।
বাজারের সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্রামীণফোনের লভ্যাংশের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ হলো- এর শেয়ারের দাম কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের তুলনায় কম ছিল। এবং অন্যদের শেয়ারের দাম বেশি হওয়ায় লভ্যাংশ প্রদানের পরিমাণ বেশি হলেও, তাদের ডিভিডেন্ড ইল্ড বা লভ্যাংশের ফলন ছিল কম।
তবে শীর্ষ বড় মূলধন বা লার্জ ক্যাপিটাল কোম্পানির মধ্যে ব্যবসায়ের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য নির্মাতা ওয়াল্টন। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং কাঁচামালের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে লোকসান করেছে।
এছাড়া, শেয়ারবাজারে মন্দার কারণে আইসিবির মুনাফায়ও নেমেছে ধ্বস। পাশাপাশি রবি, রেনাটা, বিকন ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, বেক্সিমকো এবং বেক্সিমকো ফার্মার মুনাফা কমেছে।
তবে দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও বার্জার পেইন্টস এবং ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর মুনাফা বেড়েছে।