অর্থনৈতিক মন্দায় কমেছে পুরানো জাহাজের আসবাবপত্র বিক্রি

বাংলাদেশ

22 December, 2022, 03:15 pm
Last modified: 22 December, 2022, 03:15 pm
পুরনো জাহাজের আসবাবপত্রের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিন হাজারের বেশি ব্যবসায়ী ও শ্রমিক।

হঠাৎ বেড়াতে আসা পর্যটকদের কিছুক্ষণের জন্য মনে হতে পারে ভুল করে তুরস্ক বা গ্রিক সাম্রাজ্যের কোনো যাদুঘরে চলে এসেছেন। থরে থরে সাঁজানো মনোমুগ্ধকর অ্যান্টিক শোপিস-ফটোফ্রেম, রাজকীয় প্রদীপ-চামচদানী, সেইফটি অ্যান্ড নেভিগেসন আইটেমসহ শতবছরের পুরোনো গ্রামোফোন। রয়েছে ব্যবহৃত-অব্যবহৃত আসবাবপত্র এবং গৃহস্থালী সামগ্রী যেমন- টিভি, ফ্রিজ, ক্রোকারিজ ও কিচেন আইটেম। তবে চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্প থেকে সংরক্ষিত এসব আসবাবপত্রের বিক্রি আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে।

"মহামারির পর, দেড় বছরে জাহাজভাঙা শিল্পের ফার্নিচার ব্যবসা ভালই চলছিল। তবে, গত জুলাই থেকে বিক্রি কিছুটা কমেছে," বলেন ফার্নিচার ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি জাহেদুল ইসলাম লিটন।

তিনি জানান, "মোট ব্যবসা প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে।"

মানের দিক দিয়ে ভালো এবং দামেও কম হওয়ায় পুরানো জাহাজের আসবাবপত্রের চাহিদা সাধারণত সারা বছরই বেশি থাকে।

চট্টগ্রাম নগরের সিটি গেইট থেকে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুপাশে প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে পুরোনো জাহাজভাঙা থেকে পাওয়া নানান জিনিসপত্রের এই বাজার। 

রাস্তার দুপাশে সারি সারি এসব দোকানে পাওয়া যায় পুরোনো জাহাজের ব্যবহৃত-অব্যবহৃত ফার্নিচার, ক্রোকারিজ, কিচেন আইটেম, বাথরুম ফিটিংস, টিভি-ফ্রিজ-এসি-কম্পিউটার-ইলেকট্রনিকস, রঙ ও তেল, ইলেকট্রিক তার ও নানান সাইজের ক্যাবল, পাইপ ফিটিংস ও মহামূল্যবান অ্যান্টিকস। 

ছবি: আবু আজাদ

এখানে সব জিনিসপত্রের দাম বাজার দরের প্রায় অর্ধেক এবং তুলনামূলক টেকসই।

ব্যবসায়ীরা জানানা, মহাসড়কের দুই পাশে কয়েকটি ধাপে গড়ে ওঠা এই বাজারে প্রায় ১ হাজার দোকান রয়েছে। ৩ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী ও কর্মচারী পুরোনো জাহাজের এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য সারাদেশে যাচ্ছে এই মার্কেট থেকে। অনলাইনেও এসব পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। 
৫ হাজারে মেলে আলিশান সোফা

ফৌজদারহাট থেকে ভাটিয়াড়ী পর্যন্ত আধা কিলোমিটারে গড়ে উঠেছে পাঁচটি ফার্নিচার মার্কেট। এসব মার্কেটের দোকানগুলোতে সরাসরি জাহাজভাঙা থেকে আসা পুরোনা সোফা পাওয়া যায় ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে, চেয়ার পাওয়া যায় ২ থেকে ৪ হাজার টাকায়। ৩ থেকে ১০ হাজারে স্টিলের আলমিরা ও ফাইল ক্যাবিনেট পাওয়া যায়। ড্রেসিং টেবিল ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা, রিডিং টেবিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার, চেস্ট অফ ডয়ার ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং আকার ভেদে খাট পাওয়া যায় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। 

মোসার্স এম.এন এন্টারপ্রাইজ এর স্বত্ত্বাধীকারী মো. নুরুল হুদা বলেন, "ফৌজদারহাট ও ভাটিয়াড়ী এলাকার ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিলামে জাহাজ থেকে এসব আসবাবপত্র ক্রয় করেন। সারাদেশ থেকে খুচরা ব্যবসায়ী ও সৌখিন ক্রেতারা এখান থেকে আসবাবপত্র কিনে নিয়ে যান।"

সিটি গেইট এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ফার্নিচার কারখানা। এসব কারখানায় জাহাজভাঙা থেকে আসা পুরোনা সোফা, চেয়ার, খাট ও আলমিরা গুলো কিছুটা সংস্কার করে বিক্রি করা হয়; তাই তুলনামূলকভাবে এসবের দাম একটু বেশি। 

ছবি: আবু আজাদ

জাহেদুল ইসলাম লিটন জানান, ১৯৮০ সাল থেকে সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়াড়ী, আবদুল্লাহর ঘাটা, চেয়াম্যানঘাটা, মাদামবিবির হাট, কদমরসুল, বার আউলিয়া ও কুমিরা এলাকায় স্ক্যাপের পাশাপাশি জাহাজের পরিত্যাক্ত আসবাবের ব্যবসার শুরু।

লোভনীয় মেরিন অ্যান্টিক কাশেকশন

পুরোনো জাহাজে শুধু যে পুরোনা আসবাব পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়। এক সময় সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেওয়া জাহাজগুলোর অ্যান্টিক শোপিস এখন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হয়ে চলে আসছে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট এলাকার অ্যান্টিক কালেকশন হাউজ গুলোতে ঢোকার পর যে কারো মনে হতে পারে, তিনি হয়তো কোনো যাদুঘরে প্রবেশ করেছেন। 

এক সময়ের অতি মূল্যবান এসব অ্যান্টিক অনেকটাই কম দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যেমন- পুরোনো দিনের কাঠের হাতলের টেলিফোন মিলবে ৩ হাজার টাকায়; ফায়ার ফাইটিং, সেইফটি অ্যান্ড নেভিগেসন আইটেম পাওয়া যায় ১ থেকে ১০ হাজার টাকায়; অ্যান্টিক ফটোফ্রেম মেলে ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। সুদৃশ্য লকার পাওয়া যায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে।

জাহাজে ব্যবহৃত অ্যান্টিক ঘড়িগুলো নজর কাড়ে যে করো। এসব ঘড়ির দাম পড়বে ২ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সাজিয়ে রাখার জন্য জাহাজের হুইল পাওয়া যাবে ১০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। এছাড়া, রঙবেরঙের জাপানি স্টোন পাওয়া যায় ২ হাজার ৫০০ টাকায়। 

নাবিকদের ব্যবহৃত সুদৃশ্য পকেট চেইন লকেট ও জাহাজের কম্প্যাস মেলে ১ থেকে দেড় হাজারে। ব্যারোমিটার ২ থেকে ৮ হাজার টাকা, টেলিস্কোপ ৩ থেকে ১০ হাজার এবং গ্রামোফোন মিলবে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকার মধ্যে। 

মেসার্স তাহিন স্টিলের ম্যানেজার মাইনুদ্দিন বলেন, "জাহাজের অ্যান্টিক মালামালগুলো নিলামে কেনা যায়না। জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি কিনতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে অনেক সময় শত বছর আগের অ্যান্টিক শো-পিসও পাওয়া যায়। নৌ ও সেনাবাহীনির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সারাদেশ থেকে অনেক সৌখিন মানুষ এসে আমাদের শো-পিসগুলো কিনে নিয়ে যান।"

ছবি: আবু আজাদ

৩ হাজার টাকায় ফ্রিজ, ১০ হাজারে এসি!

ভাটিয়াড়ীর এলাকার আবদুল্লাহর ঘাটা ও চেয়াম্যানঘাটা এলাকায় রাস্তার দুই পাশের একশোর মত দোকানে পাওয়া যায় জাহাজে ব্যবহৃত সব ধরনের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য। দামে কম, কিন্তু মানে ভালো এইসব পণ্যের কদরও বেশি। 

এসব দোকানে মাত্র ৩ হাজার টাকায় মিলবে একটি ফ্রিজ, আবার মাত্র ১০ হাজার টাকায় মিলবে ১ টনের এসি! ওয়াসিং মেশিন মিলবে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। 

মেসার্স শাহ আমানত ট্রেডার্সের স্বত্তাধীকারী মো. সিরাজদ্দৌলা রাফি বলেন, "জাহাজের অধিকাংশ ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কোয়ালিটিও ভালো হয়, তাই দেখেশুনে কিনতে পারলে ক্রেতারা ঠকবেন না।" 

নারীদের প্রথম পছন্দ কিচেন মার্কেট

জাহাজভাঙার নানান পণ্যের ভিড়ে কিচেন মার্কেটের প্রতি আলাদা আগ্রহ নারী ক্রেতাদের। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি সংলগ্ন দোকান গুলোতে জাহাজে ব্যবহুত হেভি মেটালের থালা-বাসন-কোসনে আগ্রহ তাদের। এছাড়াও, রয়েছে নানান পদের ক্রোকারিজ পণ্য। 

মেসার্স এস এস এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধীকারী মো. সুমন জানান, এসএসের তৈরি বোল, থালা-বাসন বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এছাড়া, অ্যালুমুনিয়ামের পণ্য প্রতি কেজি ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়। সিরামিকের ক্রোকারিজ বিক্রি হয় প্রতি পিস ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।

এছাড়াও রয়েছে মেটাল হটপট, ক্যাটলি, সুপবাটি, তামার বাটি, হাড়ি-পাতিল, ছুরি-চামচসহ নানান ক্রোকারিজ পণ্য। 

লাইফবোটের জমজমাট বাজার

জাহাজভাঙা শিল্পকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন খালের ওপর গড়ে উঠেছে ভাসমান বাজার সেখানে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি জাহাজের লাইফবোট। সম্পূর্ণ ফাইবারের তৈরি প্রতিটি লাইফবোটের বিক্রয়মূল্য ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মদনহাট খাল, মাদামবিবিরহাট ইছামতী খাল ও সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন খালে অন্তত ৫০টি প্রতিষ্ঠান খালের পাশে লাইফবোটের পসরা সাজিয়েছে। 

ব্যবসায়ীরা জানান, সমুদ্রে ছোট ডিঙ্গি নৌকার পরিবর্তে জেলেরা স্বল্পমূল্যের লাইফবোট ক্রয় করেন। প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে গড়ে বড় সাইজের ৩ থেকে ৪টি এবং ছোট সাইজের ১৫টি বোট বিক্রি করে থাকে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.