কমেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ, জেনারেটর চালাতে জ্বালানি খরচ বাড়ছে সরকারি অফিসে

বাংলাদেশ

18 October, 2022, 02:30 pm
Last modified: 18 October, 2022, 11:00 pm
ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে সরকার যখন জ্বালানী খাতে বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম খরচ করার সার্কুলার জারি করেছে, ঠিক সেসময়ই লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জ্বালানী ব্যয় বাজেট বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বাজেটে বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করার অনুমতি চাওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি ব্যয় মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাচ্ছে।

জ্বালানি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক রিজার্ভ বাঁচানোর লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সব সরকারি অফিসে জ্বালানির খরচ ২০ শতাংশ কমাতে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল- তা তেমন প্রভাব ফেলেনি বলেই দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকারি অফিসে জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রংপুর অফিসের কথা। লোডশেডিং এর কারণে গত জুনে এই অফিসের জেনারেটর চালাতে ১৬ হাজার টাকার জ্বালানি তেল খরচ হলেও পরের মাসে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ১.৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে অফিসটিতে জ্বালানী ব্যয় বেড়েছে ৭১৮%।

এই অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, লোডশেডিং এর কারণে জুন মাসের চেয়ে জুলাই মাসে প্রায় ২০ গুণ বেশি সময় ধরে জেনারেটর চালু রাখতে হয়েছে তাদেরকে, এতে বেড়েছে জ্বালানি খরচ।

একই অবস্থা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি) এর ক্ষেত্রেও।

তারা বলছে, অফিস চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৩ ঘণ্টা জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে জেনারেটর চালাতে দৈনিক ১০৫ লিটার ডিজেল লাগছে।

এই বাড়তি ডিজেল ব্যয় মেটাতে চলতি অর্থবছর বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

একইভাবে খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টখাতে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে লোডশেডিং এর বদলে দেশজুড়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ায় এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে সরকার যখন জ্বালানী খাতে বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম খরচ করার সার্কুলার জারি করেছে, ঠিক সেসময়ই লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জ্বালানী ব্যয় বাজেট বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে।

এছাড়া, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণেও এ খাতে ব্যয় বেড়েছে। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বাজেটে বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করার অনুমতি চাওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি ব্যয় মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাচ্ছে।

গত ২১ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় জারি করা এক পরিপত্রে পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৮০% ব্যয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থা ওই নির্দেশনা প্রত্যাহার চেয়ে বাজেট বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করার পাশাপাশি এখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে জ্বালানী খাতে বরাদ্দের ২০% সাশ্রয় করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান শতভাগ ব্যয় করার অনুমতির পাশাপাশি অতিরিক্ত বরাদ্দ চাচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।"

"আবেদনগুলো কেস বাই কেস পর্যালোচনা করে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হবে কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে," জানান তিনি। 

জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক দেশের একমাত্র বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইবির জন্য জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের কাছে লেখা চিঠিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলেছে, "বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা করে লোডশেডিং এর কারণে গবেষণাসহ অন্যান্য কার্যক্রম মারাত্বকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অফিস চলাকালীন সময়ে বিদ্যুৎ অনিয়মিতভাবে বন্ধ হওয়ায় কোন গবেষণা প্রকল্পের কাজই সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না এবং মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলোর ক্ষতি হচ্ছে।"

"বর্তমান পরিস্থিতিতে ৩-৪ ঘণ্টা বৈদ্যুতিক জেনারেটরের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে," বলেছে মন্ত্রণালয়।
 
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলেছে, এনআইবির পেট্রোল, অয়েল এন্ড লুব্রিকেন্টখাতে চলতি অর্থবছরে ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে, যার মধ্যে জেনারেটরের ডিজেল ক্রয়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা যাবে।

কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ৩ ঘণ্টা করে লোডশেডিং এর হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় ৭০ ঘণ্টা লোডশেডিং হলে এর জন্য ২৪৫০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন, যার মূল্য ৩.৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে ব্যয় হবে ৪২.৩৩ লাখ টাকা। ফলে জেনারেটরের ডিজেল কিনতে এনআইবিকে অতিরিক্ত ৩৭.৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

গত ২ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৫টি গাড়ির বিপরীতে পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টখাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিতে তারা আরো বলে, "বরাদ্দের ২০% সাশ্রয় করে সর্বোচ্চ ৮০% ব্যয় করলে টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু জ্বালানীর দাম আগের চেয়ে ১.৪গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অর্থে প্রতিমাসে সর্বোচ্চ ১০০ লিটার ডিজেল বা অকটেন সরবরাহ করা সম্ভব হবে, যা দিয়ে সরকারের চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।"

এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরে খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টখাতে মোট বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করার অনুমতি দেওয়াসহ অতিরিক্ত এক কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এদিকে, খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ও পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টখাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে।

স্থানীয় সরকারের খুলনা বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, তার বিভাগের পরিচালককে প্রতিমাসে কমপক্ষে ১২টি দপ্তর ও প্রকল্প পরিদর্শন এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্টখাতে বরাদ্দ কম থাকায় এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।  

এছাড়া, পুলিশ সদরদপ্তরও চলতি অর্থবছর জ্বালানি তেলে বরাদ্দের শতভাগ ব্যয়ের অনুমোদনসহ এখাতে অতিরিক্ত প্রায় ২০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এছাড়া, নতুন করে গাড়ি কেনার জন্য ২২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে পুলিশ।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়ার কারণে পুলিশের মোবিলিটি বৃদ্ধি, নতুন সৃষ্ট পদের পদের বিপরীতে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন হওয়ায় এবং মোটরযান বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের সদর দপ্তর।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.