ধীর গতির সঞ্চালন নেটওয়ার্ক প্রকল্পে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ 

বাংলাদেশ

16 October, 2022, 12:20 am
Last modified: 16 October, 2022, 10:56 am
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড সক্ষমতা অর্জন হলেও, অপর্যাপ্ত সঞ্চালন (ট্রান্সমিশন) নেটওয়ার্কের কারণে বিতরণ সর্বোচ্চ হতে পারেনি। নির্ভরযোগ্য, নিরবচ্ছিন্ন একটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ৬৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার ১৭টি প্রকল্প রয়েছে; কিন্তু, সেগুলো বাস্তবায়নের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক ধীর লয়ে চলছে। 

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড সক্ষমতা অর্জন হলেও, অপর্যাপ্ত সঞ্চালন (ট্রান্সমিশন) নেটওয়ার্কের কারণে বিতরণ সর্বোচ্চ হতে পারেনি। 

নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্ন একটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ৬৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার ১৭টি প্রকল্প রয়েছে; কিন্তু, সেগুলো বাস্তবায়নের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক ধীর লয়ে চলছে। 

যেমন ২০১৬-২০২০ অর্থবছর সময়ে বিভিন্ন সক্ষমতার মাত্র ২ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার সঞ্চালন (ট্রান্সমিশন) লাইন স্থাপন করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ। যা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় থাকা ৮ হাজার কি.মি. লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ শতাংশ।  

বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল পরিকল্পনা ও অবহেলার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দ্রুত বাড়লেও, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হচ্ছে না ট্রান্সমিশন লাইন সম্প্রসারণ।

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ অর্থবছর থেকে পাঁচ বছরে, মোট সঞ্চালন সিস্টেমের দৈর্ঘ্য মাত্র ২৬.৬৯% বেড়ে ৯,৬৯৫ কি.মি. হয়েছে। সে তুলনায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৩ হাজার ৫৪৯ মেগাওয়াট থেকে ৭৪ শতাংশ বেড়ে ২০২০ অর্থবছরে হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। 

এজন্য  ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, উন্নয়ন-সহযোগী ঋণদাতাদের দেওয়া নানান শর্ত, দরপত্র নথি প্রস্তুত এবং ঠিকাদার নির্বাচনে বেশি সময় লাগা এবং ধীরগতিতে তহবিল ছাড়করণকে দায়ী করেছেন প্রকল্প পরিচালকরা।   

এই পরিস্থিতিতে সঞ্চালন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করতে নেওয়া প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যা করা হলে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে করা বিনিয়োগের সর্বোত্তম সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা।  

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ তামিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, বাস্তবায়ন করা না গেলে এত বড় বড় প্রকল্প নেওয়ার কোনো স্বার্থকতা দেখেন না তিনি। 

তিনি বলেন, 'বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সঞ্চালন লাইন যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সাবস্টেশনের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রকল্প অনুমোদনের বাইরে আর কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না'। 

প্রকল্প যেভাবে দীর্ঘায়িত হয়?

সঞ্চালন লাইন নির্মাণে চলমান ১৭ প্রকল্প প্রকল্পের মধ্যে ১৩টির মেয়াদ এক বা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর হওয়ায় অপেক্ষাকৃত নতুন চারটি প্রকল্পের মেয়াদও বাড়াতে হবে।  

উদাহরণস্বরূপ, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ঘোড়াশাল-টঙ্গী ২৮ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইনসহ মোট ২৬৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে, যার ডেডলাইন ধরা হয় ২০১৭ সালের জুনে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিটি নির্দিষ্ট সময়ে পুরোদমে কাজ শুরু করতে না পারায় চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটির মেয়াদ আরও সাড়ে পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।

অন্য একটি উদাহরণে, '৪০০/২৩০/১৩২কেভি গ্রিড নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প'। এটির বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে  আগামী ডিসেম্বরে, অথচ এখনও প্রকল্পের ১৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই  প্রকল্পটি শেষ করার কোনো পরিকল্পনা নেই কর্তৃপক্ষের। তারা মেয়াদ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

প্রকল্প পরিচালক ও পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অপ্রত্যাশিত এই দেরির পেছনে বেশকিছু জোরালো কারণ আছে। 

যেমন প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৩ সালে, আর ভৌত কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। ঠিকাদার নির্বাচনে দেরির কারণে কাজ শুরু হতে দেরি হয়। এছাড়া,  দুটি সাব-স্টেশনের কাজ এখনও শুরু হয়নি।

তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়ন করা অংশের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়ন করা অংশের কাজ পিছিয়ে রয়েছে। একারণে চলতি অর্থবছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করা যাবে না।

দেরির কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না 

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ মোংলা থেকে ঢাকা প্রকল্প পর্যন্ত  ১৭৪ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণের গতি বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় অলস পড়ে রয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ইউনিট উৎপাদন সক্ষমতা। 

২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পের আওতায় গোপালগঞ্জ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত  ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনটি ২০২০ সালের জুনের মধ্যে নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এর মাধ্যমে পায়রা, রামপাল এবং অন্যান্য প্ল্যান্ট  রাজধানীতে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্য নেওয়া হয়। চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানো হয়েছে।

২০২০ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, প্রকল্পটির বিলম্বের কারণে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পূর্ণ সক্ষমতা হয়তো কাজে লাগানো যাবে না। 

প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা ধরা হয়। প্রকল্প পরিচালনায় সংশোধনের পর যা ৮৫% বাড়িয়ে করা হয় ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। আগামী বছর এটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।  

২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইন পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে ২২৭.৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন বসানোর কথা ছিল। এই মেয়াদ পরে আরও আড়াই বছর বাড়ানো হলেও, অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭১ শতাংশ। 

গ্রিড-ভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে শক্তি দক্ষতার মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়, যা গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু, ছয় বছরে মাত্র ৩৩ শতাংশ অগ্রগতি হওয়ায়– আট বছরে ১৭৭ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করা নিয়েও সংশয় রয়েছে। 

রূপপুর

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ৬৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সঞ্চালন লাইন স্থাপনের প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে যা ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সময়সীমা বাড়িয়েছে। এটির বাস্তবায়নে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মোট ১০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বরাদ্দের মাত্র ২৭ শতাংশ।

২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ১৪ হাজার ৩২৬ কোটি টাকায় চলছে পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। চীনের সহায়তায় নেয়া এই প্রকল্পের আওতায় গত বছরেই ৭৬৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন বিভিন্ন সক্ষমতার সাবস্টেশন নির্মাণে কথা ছিল।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ জানিয়েছে, গত ছয় বছরে প্রকল্পের ১৬ শতাংশেরও কম কাজ করা হয়েছে।

ফলে চার বছর নয় মাস মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত আরও তিন বছর বাড়ানো হয়েছে।

বিদেশি ঋণদাতাদের ওপর অতি-নির্ভরতা

সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ১৭টি প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৬০ শতাংশই বিদেশি ঋণে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর অতি-নির্ভরশীলতার কারণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ হচ্ছে। কারণ, উন্নয়ন ঋণদাতাদের নির্ধারিত বিভিন্ন শর্তাবলী মেনে অর্থ ছাড় হতেও সময় লাগে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, দ্রুত কাজ শেষ করতে হলে এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়িয়ে বৈদেশিক ঋণ-নির্ভরতা কমাতে হবে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা। এতে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলির অদক্ষতার কারণে এডিপিতে বিদেশি সহায়তার অংশ গত কয়েক বছর ধরে ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে যতগুলো প্রকল্পের প্রস্তাব এসেছে তার প্রায় সবগুলোই অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণেও অনেক প্রকল্প রয়েছে। তারপরও সময়মতো এসব প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়াটাকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.