আবার শুরু হয়েছে ঢাকা বিআরটির কাজ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে নেই কোনো উদ্যোগ

বাংলাদেশ

08 October, 2022, 04:35 pm
Last modified: 09 October, 2022, 02:15 pm
গত ১৫ আগস্ট এ প্রকল্পের গার্ডার স্থাপনের সময় চরম অবহেলার কারণে তা ধসে ৫ জনের মৃত্যুর পর কাজ বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। নাগরিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিআরটি নির্মাণের কাজ শুরু করতে দেওয়া হবে না মর্মে সেসময় ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর কোন ঘোষণা না দিয়েই অনেকটা চুপিসারে এই প্রকল্পের কাজ সম্প্রতি আবারো শুরু হয়েছে।

বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবারো শুরু হয়েছে বিআরটি-৩ প্রকল্পের কাজ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই কাজ চলছে রাজধানীর বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে দ্রুতগামী বাসের জন্য পৃথক লেন তৈরির কাজ।

গত ১৫ আগস্ট এ প্রকল্পের গার্ডার স্থাপনের সময় চরম অবহেলার কারণে তা ধসে ৫ জনের মৃত্যুর পর কাজ বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। নাগরিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিআরটি নির্মাণের কাজ শুরু করতে দেওয়া হবে না মর্মে সেসময় ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর কোন ঘোষণা না দিয়েই অনেকটা চুপিসারে এই প্রকল্পের কাজ সম্প্রতি আবারো শুরু হয়েছে।

গাজীপুরের সালনা এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শোয়েব উল্লাহ উত্তরা সেক্টর-৭ এর বাসা থেকে নিয়মিত গাড়িতে করে যাতায়াত করেন।

তিনি বলেন, "বিআরটি প্রকল্পে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে উত্তরা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।"

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

"অনেক জায়গায় যেখানে ফ্লাইওভারের কাজ চলছে, তার নিচেই প্রধান সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। কোনো ধরনের ব্যারিকেড ছাড়াই কাজ চলছে সড়কে। বাঁশের তৈরি রোড ডিভাইডার পার হতে যেয়ে অনেকসময়ই পথচারীরা গাড়ির সামনে এসে পড়েন," যোগ করেন তিনি।

সম্প্রতি সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যেয়ে বিমানবন্দর পার হয়েই রাস্তার ওপরে দেখা গেছে বালির স্তুপ। ১৫ আগস্টের দুর্ঘটনার পর বালির ওপরে সুতর জাল ফেলে রাখা হলেও এই জাল ভেদ করে বালির স্তুপ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। 

উত্তরা ১ নং সেক্টের থেকে জসিম উদ্দিন মোড় পর্যন্ত রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে কংক্রিটের বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী। হাউজ বিল্ডিং পার হয়ে রাস্তার পিচ (পেভমেন্ট) বরাবর রয়েছে লম্বা গর্ত। চেরাগ আলী এলাকায় নিরাপত্তা পোশাক ছাড়াই লোকজন উঠছে বিআরটির নির্মানাধীন উড়াল লাইনে।

টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত নির্মাণ এলাকায় রাস্তার ডিভাইডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ। এই বাঁশের প্রতিবন্ধকতার ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে অনেককে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে।

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

টঙ্গী থেকে বনানী পর্যন্ত মোটরসাইকেলে নিয়মিত যাতায়াতকারী ওবায়দুল্লাহ বলেন, "আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গর্ত খোঁড়া হয়েছে। রাস্তায় পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যা মোটরসাইকেলের জন্য মরণফাঁদ।"

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ টিবিএসকে বলেন, "জনসাধারণের পাশাপাশি শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে কাজ পুনরায় শুরু করা হয়েছে।"

তবে নতুন করে কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "দুর্ভাগ্যজনক যে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।"

তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য ঠিকাদারকে দায়ী করে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

"বিআরটি প্রকল্পের শুরু থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমস্ত দিক ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়ে আসছে। এই ধরনের অবহেলার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ব্যয় বাড়িয়ে ও ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ঠিকাদারকে পুরস্কৃত করেছে কর্তৃপক্ষ," বলেন প্রফেসর হাদিউজ্জামান।

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীনতার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স (এফআইডিআইসি) আইন অনুযায়ী ঠিকাদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা ছাড়াও দেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বিআরটি প্রকল্পের পরামর্শক ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট (ইপিসিএম) আগেই রোড ডিভাইডার ও বেড়াতে বাঁশের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল।

সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পর প্রকল্পের বেশ কয়েকটি নির্মাণস্থলে সাদা রঙের টিন দিয়ে বেড়া বসানো হয়েছে। কিন্তু স্টেশন রোডের দুপাশে লাগানো বেড়া হেলে পড়তে দেখা গেছে।

উপেক্ষিত শ্রমিক নিরাপত্তা

টঙ্গীর বাটা স্টোরের সামনের রাস্তায় একটি বিআরটি নির্মাণের জায়গা পরিদর্শনে দেখা যায়, শ্রমিকরা কোনোধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানছে না।

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

এরমধ্যে একদল শ্রমিককে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে, কিন্তু কেউ হেলমেট বা গ্লাভস পরেনি।

জানতে চাইলে পঞ্চশোর্ধ সুলাইমান নামের এক শ্রমিক বলেন, প্রচণ্ড গরমে হেলমেট ও গ্লাভস পরে কাজ করতে তাদের কষ্ট হয়।

গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে বিআরটি নির্মাণস্থলেও একই দৃশ্য দেখা গেছে।

বুধবার এই প্রকল্পের একটি খননকাজ চলার সময় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি নিরাপত্তামূলক জুতা, হাতের গ্লাভস, হেলমেট এবং নিরাপত্তা বেল্টের মতো সুরক্ষামূলক পোশাক না পরেই একটি এক্সক্যাভেটর চালাচ্ছেন।

কাজের অগ্রগতি

২০১৬ সালে এই রুটে বিআরটি বাস চালু করার জন্য ২০১২ সালে ২০৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা এ প্রকল্পটি সেসময়ই ছিল বেশ ব্যয়বহুল। প্রকল্পের প্রাক্কলিত বরাদ্দ অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

এরপর বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ। সাম্প্রতিক হিসাবে, প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে বর্তমানে হয়েছে প্রায় ৪২৬৮ কোটি টাকা, যা কয়েক বছরে বেড়েছে ১০৯%। 

চলতি বছরের ডিসেম্বরে বিআরটি লাইন-৩ এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে।

সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্প প্রণয়ন, নকশা, বাস্তবায়ন নিয়ে অসংখ্য সমস্যার কারণে এভাবে মেয়াদ বাড়ানোয়, চার বছরের কাজ ১১তম বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। 

ছবি- রাজীব ধর/ টিবিএস

প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে তেমন কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও, আগামী মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করে তিন মাস পর বিআরটি লাইনটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

গত মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০.৫ কিলোমিটার সড়কের মাত্র ৬৫ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে, যেখানে ১০ লেনের টঙ্গী সেতুর কাজ ৭০ শতাংশ হয়েছে।

বাস ডিপো নির্মাণের কাজ শেষ হলেও ছয়টি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের অগ্রগতি বর্তমানে ৮৫.৫৮%, উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.