অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজে ভাঙছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
বাংলাদেশ
অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত এবং দেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙনের সূত্রপাত হয়েছে, যা প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা শহর সংলগ্ন প্রায় ৪ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ধ্বসে গেছে লাবণী পয়েন্ট, কবিতা চত্বর, শৈবাল পয়েন্ট ও সী-গালের সামনের সৈকত। বিলীন হয়ে গেছে প্রায় এক কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক।
সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে কক্সবাজার সৈকতে।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, ভাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। বিশাল বিশাল গর্তে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে লাবণী ও শৈবাল পয়েন্ট সৈকত। বিলীন হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, ঝাউগাছ।
ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে আছে, ডায়াবেটিস পয়েন্টের বিয়াম ল্যাবটরির ভবন, সুগন্ধা পয়েন্টে জেলা পরিষদের চেঞ্জ রুমসহ লাবণী পয়েন্টে ও সায়মান বিচের একাধিক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। সৈকত রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরিভাবে কিছু জিও ব্যাগ ফেলেছে। লাবণী পয়েন্টে সমুদ্রে না নামতে বালুচরে টাঙানো হয়েছে ১০টির বেশি লাল নিশানা।
তবে মেরিন বিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতিকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কক্সবাজার সৈকতের যে অংশটিতে বর্তমানে ভাঙ্গন চলছে সেটি ভাঙ্গন প্রবণ না। এখানে ভাঙ্গনের মূল কারণ হচ্ছে সৈকতে পলি ও বালি আসার পরিমাণ কমে যাওয়া।'
'আমাদের বড় বড় নদীগুলো দিয়ে হিমালয়সহ উজান থেকে সমুদ্রে পলি বয়ে নিয়ে আসে। এসব পলির একটি অংশ ঢেউয়ের সঙ্গে সৈকতে এসে জমা হয়। যদি এই পলির পরিমাণ বেশি হয় তাহলে সৈকত প্রশস্ত হয়। বিপরীতে সমুদ্র স্রোত যদি সৈকত থেকে এর চেয়ে বেশি বালি নিয়ে যায়, তাহলে সৈকতে ভাঙ্গন হবে।'
'পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বর্তমানে যে পরিমাণ পলি নদীর মাধ্যমে আসছে, তারচেয়ে বেশি পরিমাণ সমুদ্রে সরে যাচ্ছে। এই দুযোর্গটি মানবসৃষ্ট, কারণ প্রতিবেশি দেশ ও দেশের ভেতরে নদীগুলোর উজানে বড়বড় বাঁধ ও ড্যাম তৈরি করে সাগরে পলি আসাকে বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে,' বলেন তিনি।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সৈকতে ভাঙ্গনের আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ও বালিয়াড়িতে ঝাউবন তৈরি।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বোরি) এর মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার টিবিএসকে বলেন, 'সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছি, যেখানে ইট-কংক্রিটের পাকা স্থাপনা রয়েছে এবং ঝাউগাছ রয়েছে সৈকতের সেখানেই কেবল ভেঙ্গেছে। আর যে সৈকতে পাকা স্থাপনার পরিবর্তে সাগরলতা ও কেয়া-নিশ্চিন্দির বন রয়েছে, সেখানে সৈকত ভাঙেনি।'
এর কারণ জানিয়ে এ সমুদ্র বিজ্ঞানী বলেন, 'শামুক-ঝিনুক সৈকতে পানির নিচে এমন কাঠামো তৈরি করতে পারে যে কাঠামো প্রাকৃতিকভাবেই জীবন্ত বাঁধ হিসেবে কাজ করে। মূলত এতকাল ধরে এই প্রাকৃতিক জৈবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের সৈকতকে রক্ষা করেছে। কিন্তু প্রকৃতির এই সুরক্ষা দেওয়াল ভেঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সৈকত সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।'
বাপার কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, 'কক্সবাজার সরকার ঘোষিত পরিবেশ বিপন্ন এলাকা হলেও প্রভাবশালীরা সমুদ্র উপকূলের 'ফ্লাড প্লেইন' এলাকায় অবৈধভাবে পাঁচ শতাধিক সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করছে।'
অন্যদিকে প্রফেসর সায়েদুর রহমানের দাবি, সৈকতে ভাঙ্গনের পেছনে বন বিভাগের তৈরি ঝাউবনেরও দায় রয়েছে।
এর কারণ ব্যাখ্য করে তিনি বলেন, 'সমুদ্র থেকে যখন অতিরিক্ত বালি এসে সৈকতে জমা হয়, তখন সি-উইন্ড অতিরিক্ত বালির একটি অংশকে সৈকতের শেষাংশে জমা করে। যদি কোনো কারণে সমুদ্র থেকে বালি আসা কমে যায়, তখন জমা হওয়া অতিরিক্ত বালি সৈকতের বালির শূণ্যতা পূরণ করে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে যেখানেই বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে, সেখানেই বন বিভাগ ঝাউগাছ লাগিয়ে বালিয়াড়িগুলোকে নষ্ট করে ফেলেছে। এখন যখন সাগর থেকে বালি আসা কমে গিয়েছে, তখন ধ্বংস হয়ে যাওয়া বালিয়াড়ি গুলো ভাঙ্গন ঠেকাতে কোনো সহায়তা করতে পারছেনা।'
বিজ্ঞানীরা মনে করেন বর্তমানে কক্সবাজার সৈকতে ভাঙ্গনের পেছনে প্রাকৃতিক কিছু কারণও রয়েছে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, 'কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বড় একটি বৈশিষ্ট ছিলো বালিয়াড়ি (বালির ডেইল)। এই বালিয়াড়িগুলো সাগর লতা দিয়ে আচ্ছাদিত ছিলো। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ থেকে সাগর লতা এই বালিয়াড়িকে রক্ষা করতো। কিন্তু ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এই বালির ডেইলটি হারিয়ে যায়। এই ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যতদিন অবশিষ্ট ছিল, ততদিন প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রায় অক্ষুণ্ণ ছিল। পরবর্তিতে এটি রক্ষায় কোনো কাজ হয়নি। বরং অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে হারিয়ে গেছে সৈকতের সুরক্ষা বলয় সাগর লতা।'
বোরির সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার মো. জাকারিয়া বলেন, 'বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে ঘনঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। ভাঙ্গন প্রবণ লাবনী পয়েন্টের জোয়ার ভাটার কো-ইফিসিয়েন্ট হিসেবে করে দেখেছি, এখানে ১০০ এর উপরে কো-ইফিসিয়েন্ট হয়। ২০২০ সালে একই পয়েন্টে কো-ইফিসিয়েন্ট ছিলো ১১৩। এই টাইডাল রেঞ্জটা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি। বর্ষাকালে এখানে সাগরের উচ্চতা ১ মিটারের বেশি বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে টাইডাল রেঞ্জ ও ওয়েভ ড্রাইভ যুক্ত হয়ে সৈকতে ভাঙ্গন ঘটাচ্ছে।'
কংক্রিটের বাঁধ কি সৈকত রক্ষার সমাধান হতে পারে?
সম্প্রতি বিডব্লিউডিবির সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি বলেন, 'কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রক্ষায় ১২ কি.মি. দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এ জন্য একনেকে জমা দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব ।'
কিন্তু সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, সৈকতে বাঁধ নির্মাণ ভাঙ্গন রোধের সমাধান হতে পারেনা। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদী সমীক্ষার মাধ্যমে টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত।
মো. জাকারিয়া বলেন, 'আমরা জানিনা এমন একটি প্রকল্প নেওয়ার আগে কোনো সমিক্ষা করা হয়েছে কিনা। আমার কাছে মনে হয় এই সমস্যার সমাধানের জন্য জিওলজিক্যাল ও ওসানোগ্রাফিক স্টাডি ছাড়া কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে তা দীর্ঘ মেয়াদে কোনো কাজ দেবে না। দীর্ঘ মেয়াদে এই সৈকতকে রক্ষা করতে হলে সৈকতের প্রকৃতিক বৈশিষ্টকে নষ্ট করা যাবে না।'
প্রফেসর সায়েদুর রহমান বলেন, 'নদী শাসন আর সৈকত রক্ষা এক জিনিস নয়। কাজেই শুধু মাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিবিলিটি স্টাডি দিয়ে এটি হবে না। প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে কক্সবাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেলে পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।'
বেলাল হায়দার বলেন, 'সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধের জন্য ইকোসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার শামুক-ঝিনুকের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে হবে। এছাড়া অপরিকল্পিত ঝাউ বনায়ন বন্ধ করে সৈকতে সাগর লতা, কেয়া-নিশ্চিন্দির বন বাড়াতে হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিল সাইফ আহমেদ বলেন, 'ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাডি ও এনভারমেন্টাল এসেসমেন্ট করেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে রিভিউর জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।'
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.