বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য খুলছে সুন্দরবন 

বাংলাদেশ

30 August, 2022, 01:45 pm
Last modified: 30 August, 2022, 03:06 pm
বন্যপ্রাণীদের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় গত ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে সকলের জন্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় বন মন্ত্রণালয়।

তিন মাস বন্ধ থাকার পর আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে বনজীবী ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের পুনরায় অনুমতি প্রদান করবে বন বিভাগ।

বন্যপ্রাণীদের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় গত ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে সকলের জন্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বন মন্ত্রণালয়।

সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, 'বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের অধিকাংশ প্রাণীর প্রজনন হয়। এই সময় যাতে বন্যপ্রাণীদের কোন ধরনের সমস্যা না হয়, সেজন্য সবাইকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে।'

তিনি বলেন, 'এটা মূলত মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তে বন মন্ত্রণালয় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এই সময়ে সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য কাউকে পাস-পারমিট দেয়া হয় না। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরদিন থেকে আবারও বনে সকলে প্রবেশের অনুমতি পাবে।'

ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে সম্পদ আহরণের জন্য বর্তমানে ১২ হাজার নৌকা ও ট্রলারকে বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দেওয়া হয়েছে। এসব নৌযানের মাধ্যমে প্রতি বছর এক থেকে দেড় লাখ জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালী সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করেন।

সুন্দরবনের কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, '১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলেদের পুনরায় বন থেকে সম্পদ আহরণের অনুমতি প্রদান করা হবে। এখন গোলপাতা ও  মধু আহরণ বন্ধ আছে। অনুমতি নিয়ে বনজীবীরা শুধুমাত্র মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন।'

সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় গ্রামগুলোর মানুষেরা সুন্দরবন থেকে এসব সম্পদ আহরণ করেন।

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের বনজীবী আব্দুস ছাত্তার বলেন, 'আমাদের গ্রামের প্রায় সব মানুষ জীবিকার জন্য কোন না কোনভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। ৩ মাস বন্ধ থাকার পর আবারও সুন্দরবনে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছি। তাই গ্রামের জেলেরা নৌকা ও জাল মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।'

তিনি বলেন, 'গত ৩ মাস বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই সময়ে আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোন সহায়তা দেওয়া হয়নি।'

'একই সময়ে আমাদের নৌকা অলস পড়েছিল। তাতে আলকাতরা দিয়ে ঠিক করা হচ্ছে। কাটাছেঁড়া জাল বুনে ঠিক করা হচ্ছে।'

খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, 'নিষেধাজ্ঞা মৌসুমে আমরা বনজীবীদের কোন ধরনের সহায়তা করতে পারি না। তবে এই বছর সরকারের কাছে বনজীবীদের সহায়তার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। আশা করি আগামী বছরগুলিতে তারা হয়তো নিষেধাজ্ঞা মৌসুমে সহায়তা পাবেন।'

বুকিং শুরু করেছে ট্যুর অপারেটররা

বন বিভাগ থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনে বর্তমানে ৭টি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র চালু রয়েছে। সেখানে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন। এছাড়া পর্যটকদের জন্য নতুন করে চারটি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

সুন্দরবনের  করমজল ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, 'বনে আসা শতকরা ৯০ ভাগ পর্যটক একবার হলেও করমজলে আসেন। এটি স্থলভাগের সব থেকে কাছে হওয়ায় সহজে পর্যটকরা আসতে পারেন। ১ সেপ্টেম্বর পুনরায় পর্যটকদের জন্য  ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র চালু হচ্ছে। এই এলাকাটি পরিষ্কার-পরিছন্ন করা হচ্ছে।'

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, 'তিন মাস ট্যুর অপারেটরগুলোর কোন কাজ ছিল না। ট্যুর অপারেটররা এখন অগ্রিম বুকিং শুরু করেছেন।'

প্রাণ ফিরেছে সুন্দরবনে

একটানা তিন মাস বন্ধ থাকার ফলে এখন সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীরা অবাধে চলাচল করতে পারছে। তাদেরকে প্রায় সময় নদীর পাড়ে দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তারা।

সুন্দরবনের কালাবগী ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের স্টেশন অফিসার (এসও) জহিরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, 'বর্তমানে তাদের নদী ও খালের পাড়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে কেউ প্রবেশ করতে পারছে না। এতে মানুষের কোলাহল ও নৌযানের শব্দ বন্য প্রাণীদের কানে যাচ্ছে না। তারা এখন অবাধ বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আগের চেয়ে বেশি পাখির কোলাহল শোনা যাচ্ছে। বড় নদীগুলোতে ডলফিনও দেখা যাচ্ছে। এখন নদীতে মাছও বেশি।'

বন বিশেষজ্ঞরা জানান, মূলত সুন্দরবনে যখন গোলপাতা আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়, সেই সময়ে বন্য প্রাণীরা নদীর তীরে একেবারেই কম আসে। বাওয়ালীরা গোলপাতা কেটে নেওয়ার জন্য নদীর পাড়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এছাড়া গোলপাতা কাটার ফলে নদীর পাড়ের চেহারা একেবারে বদলে যায়, যা বন্য প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এছাড়া মৌয়ালরা যখন মধু সংগ্রহ শুরু করে, তারা বনের গহীনে দল বেঁধে মৌচাক খুঁজতে মাইলের পর মাইল হাঁটাহাঁটি করেন। তাতে বন্য প্রাণীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়। তারা মধু আহরণের জন্য খড়কুটোতে আগুন দিয়ে মৌচাকের মৌমাছি তাড়ায়, তখন আশেপাশের বন্য প্রাণীরা দৌড়ে পলায়ন শুরু করে।

অসাধু জেলেরা মৎস্য আহরণের জন্য বিভিন্ন নদী-খালে বিষ দেয়। জেলেদের ভাষ্য মতে, একবার কোন খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করলে, আগামী ১৫ দিন সেই খালে কোন মাছই পাওয়া যায় না। ওই খালের মাছের ডিম পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।
পর্যটকরা বনে গিয়ে হরিণ ও বানরকে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করে। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের বর্জ্য বনের অভ্যন্তরে ফেলে।

সুন্দরবন থেকে ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে সম্পদ আহরণ করা বনজীবী রনজিল বাওয়ালী বলেন, 'জেলেরা বনে থাকলে টুকটাক গাছপালা কাটে। কিছু কিছু কাজ করে যা অবৈধ। আবার অসাধু জেলেরা বড় আকারের অপরাধও করে। অনেকে হরিণ শিকার বা বিষ দিয়ে মাছও ধরে। তাদের অনেকে বন বিভাগের হাতে আটক হন। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকাকালে বনের উপর কোন অত্যাচার হয় না। তখন আপনাআপনি সুন্দরবন সতেজ হয়ে উঠে।'

তিনি বলেন, 'প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞার পর যখন বন চালু হয়, তখন আমরাও বনে গিয়ে অনেকটা নতুন রূপ দেখতে পাই। প্রথম দিকে মাছও বেশি পাই। পাখির ডাক শুনতে পাই। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বনের অবস্থায় পরিবর্তন আসে।'

করমজল স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, '‌চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে বনে মানুষের পদচারণা ও পরিবেশে নৌযানের বিকট শব্দ নেই। সুনসান নীরবতায় বনের প্রকৃতিতে ভিন্ন রূপের সৃষ্টি হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সুন্দরবন তার নিজস্ব রূপে ফিরেছে।'

বিরক্ত না করলে টিকবে বন

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, 'সুন্দরবনে একদিকে প্রতিবছর বনজীবীর সংখ্যা বাড়ছে, অপরদিকে বনের সম্পদ কমছে। বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বন সুরক্ষার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী মাস্টারপ্ল্যান করলে সুন্দরবন আরও বেশি সুরক্ষিত থাকত।'

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলছেন, 'নিয়মতান্ত্রিকভাবে বন থেকে সম্পদ আহরণ না করা হলে স্বাভাবিক ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) ক্ষতি হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজস্ব নিয়ে বনজীবীদের সম্পদ আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়। সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আসছে এই চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। বিরক্ত না করে বনটাকে বনের মতো থাকতে দিতে হবে। তা হলে সেখানের ইকোসিস্টেমের কোনো ক্ষতি হবে না।'

তবে ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, 'পুরো সুন্দরবনটাই সংরক্ষিত, পূর্ব অনুমতি ছাড়া কেউ চাইলেই সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ স্থান অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কোনো জেলে, বাওয়ালি বা বনজীবী প্রবেশ করতে পারে না। ভবিষ্যতে আরও এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হবে।' 
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.