এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি কক্সবাজার নদীবন্দর

এক যুগ আগে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) কক্সবাজার বাঁকখালী নদী বন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে সরকার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ফোরশোরের (নদী তীরবর্তী ভূমি) প্রায় ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিলো। কিন্তু জেলা প্রশাসনের আপত্তিতে নদী বন্দর বাস্তবায়নের কার্যক্রম পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় যৌথ জরিপের মাধ্যমে ফোরশোর নির্ধারণ হলেও সে নির্দেশনা প্রতিপালন করেনি জেলা প্রশাসন।
বিআইডব্লিউটিএ'র তথ্যমতে, ২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিআইডব্লিউটিএ-কে বাঁকখালী নদী বন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে ফোরশোরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিলো। কিন্তু জেলা প্রশাসনের আপত্তির কারণে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর ফোরশোর ভূমি পুনঃ যৌথ জরিপ করা হয়। জরিপে নির্ধারিত ২৬৯ দশমিক ৪২৫ একর ভূমি নির্ধারিত হলে সেটিও বাস্তবায়ন করেনি জেলা প্রশাসন।
সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএ'র এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাঁকখালী নদী বন্দরটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় নদীতীরের ভূমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নদী দখলের সাথে যুক্ত রয়েছে কক্সবাজারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভরাট করে দখলে নিয়েছে। সংস্থাটি তাদের তদন্ত রিপোর্টে নদী দখলের সাথে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করে দখলদারকে উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি দেয়। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং আদালত অবমাননা করে সময়ক্ষেপণ করছে জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিআইডব্লিউটিএ'র পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের গুরুত্ব বিবেচনা করে সেখানে একটি নদী বন্দর ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য এ নদী বন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে এ নদী বন্দরটি সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস।
কিন্তু কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতার বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বিআইডব্লিউটিএ ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধান ও যৌথ জরিপের নির্ধারণকৃত ২৬৯ দশমিক ৪২৫ একর তীরভূমি বিআইডব্লিউটিএ'র অনুকূলে হস্তান্তরের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর একটি চিঠি দেয়। কিন্তু এসবের কিছুই মানছেনা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
প্রজ্ঞাপনের দীর্ঘদিন পরেও কক্সবাজারের বাকখালী নদী বন্দরের ফোরশোর হস্তান্তর না করায় মহেশখালী উপজেলার নাগরিক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রায়হানুল মোস্তফা স্ব-প্রণোদিত হয়ে উক্ত নদী বন্দরের তীরভূমি সহ মহেশখালী জেটি দ্রুত বিআইডব্লিউটিএ'র অনুকূলে হস্তান্তরের নির্দেশনা প্রার্থনা করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (নং-১১৭৭৪/২০১৩) দায়ের করে।
রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে ২০১৬ সালে রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে নদী তীরভূমি বিআইডব্লিউটিএ-কে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৭ কনটেম্পট পিটিশন (নং-৪৯২/২০১৭) উদ্ভব হয়। কনটেম্পট এর প্রতিপক্ষ করা হয়েছে যথাক্রমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিআইডব্লিউটিএ'র চেয়ারম্যানকে। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক ও বিআইডব্লিউটিএ পুনঃ যৌথ জরিপের মাধ্যমে ফোরশোর ভূমি ও সেলামি নির্ধারণ পূর্বক জেলা প্রশাসককে প্রেরণ করা হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
এই বিষয়ে রিট পিটিশন দায়ের কারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রায়হানুল মোস্তফা বলেন, সরকার কক্সবাজার অঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামো ও শিল্প খাতের উন্নয়নের স্বার্থে বাঁকখালী নদী বন্দর ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় জেলা প্রশাসন নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে নদী তীর হস্তান্তর করছে না। যার কারণে বাঁকখালী নদীর দুই তীর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার দখলে চলে গেছে। পরিবেশ রক্ষা ও মানুষের দুর্ভোগ লাগবের জন্যই বাঁকখালী নদী তীর দ্রুত সময়ের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ'র কাছে হস্তান্তর জরুরী। রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে আদালত অবমাননা করে দুটি সরকারি সংস্থার এই দ্বন্দ্ব কোনভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করেন তিনি।
পরিবেশ কর্মী মোয়াজ্জেম রিয়াদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নদী বন্দরটি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে বাঁকখালী নদীর দখল হয়ে নদী সংকুচিত হয়ে পড়ছে। গত এক দশক ধরে কক্সবাজার অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে সরকার। কিন্তু দেশের প্রধানতম পর্যটন এলাকা হলেও একটি পরিপূর্ণ নদী বন্দর না থাকায় এই খাতের শতভাগ উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। মহেশখালী, চকরিয়া সহ কক্সবাজার অঞ্চলে একাধিক বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও নদী বন্দর সুবিধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার না হওয়ায় এসব উন্নয়ন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।
এই বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেন, বাঁকখালী নদীকে নদী বন্দর ঘোষণার বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুরনো। মহামান্য হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কিন্তু ঠিক কোন কারণে এতদিন নদীর তীরভূমি বিআইডব্লিউটিএ-কে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করছে। পুরনো দলিলাদি পর্যালোচনা করে শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিআইডব্লিউটিএ'র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন টিবিএসকে বলেন, 'সরকারের ব্লু ইকোনমি কার্যক্রম, সমুদ্র সম্পদ আহরণ এবং এ সংক্রান্ত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে বাঁকখালী নদীবন্দর স্থাপন খুবই জরুরী। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন আমাদের নদী তীরভূমি বুঝিয়ে দেয়নি। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চেয়েছি। দুই সংস্থার মধ্যে সৃষ্ট সংকটটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে।'