২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংক রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানির এলসি নিশ্চিত করতে রাজি হয়েছে

বাংলাদেশ

26 August, 2022, 12:00 am
Last modified: 26 August, 2022, 02:09 pm
রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সার ও গম আমদানি চূড়ান্ত করা হলেও, ডলারে অর্থ পরিশোধ করা যাবে কিনা– তা নিয়ে সংশয়ে ছিল সরকার।

রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে খাদ্যশস্য ও সার আমদানির মূল্য পরিশোধ (পেমেন্ট) নিয়ে যে অনিশ্চয়তার মেঘ জড়ো হয়েছিল তা দূর হয়েছে। এসব দেশ থেকে আমদানির জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র (এলসি) নিশ্চিত করতে রাজি হয়েছে ২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংক। বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) এসব কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। 

তবে তিনি ব্যাংকগুলির নাম নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।

নাম না প্রকাশের শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মস্কোর সাথে এখনও ডলারে লেনদেন করছে এমন ২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংকের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ রাশিয়াই দেয় বাংলাদেশকে।

তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়ার যে ব্যাংকগুলি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে তারা ডলারে পেমেন্ট গ্রহণে সম্মতি দিয়েছে। এতে আমদানি স্বাভাবিক হয়ে অচিরেই দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমবে বলেও আশাপ্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা। 

যুদ্ধরত রাশিয়া-ইউক্রেন এবং বেলারুশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধ পদ্ধতি পর্যালোচনা বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সভাশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমরা সবাইকে জানাতে চাই যে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্য আমদানিতে কোনো সমস্যা নেই। অতএব, আমাদের ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই'- নিশ্চিত করেন তিনি।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, 'আমদানির ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অর্থ পরিশোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে। আপনারা দেখতে থাকেন, ধারাবাহিকভাবে চাল, গম দেশে আসতে থাকবে এবং স্থানীয় বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুতই কমে আসবে।'

কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম ও ১.২ লাখ টন এমওপি সার আমদানির প্রক্রিয়ায় এখন আর কোনো বাধা নেই।

এর আগে গত মঙ্গলবার কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাশিয়ার সাথে লেনদেনে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খোলা এলসি কনফার্মেশন দিচ্ছে না বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো। 'এই পরিস্থিতিতে সার ও গম আমদানির অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা কী হবে- তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে'।

তবে বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সভায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়া নিয়ে তারা আলোচনা করেননি। এর আগে বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে রাশিয়ার অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল রপ্তানির অর্থ পরিশোধ কোন মুদ্রায় করা হবে তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়ার প্রায় তিন শতাধিক ব্যাংকের মধ্যে সাতটিকে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা আদানপ্রদানের ব্যবস্থা- সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। 

বাকি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মূলত ১৫টি রুশ ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করে থাকে। এসব ব্যাংকের সঙ্গে ডলারে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এলসি করলে তা নিশ্চিত (এড-কনফার্ম) করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যাংকগুলোর সম্মতি প্রয়োজন হয় ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, মস্কোর একে বারস ব্যাংক এবং ব্যাংক জেনিট- এর মাধ্যমে ডলারে এলসি দিয়ে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, যাদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। 

এ দু'টি ব্যাংকের সঙ্গে করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকিং রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকের। রাশিয়া থেকে গম, সার বা অন্য কোনো খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক রুশ ওই দুই ব্যাংকে এলসি দিলে তা মাশরেক ব্যাংক এড-কনফার্ম করে থাকে, যা এখনও চলমান রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

এর আগে, গত ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও একই তথ্য জানায়। তাতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত রুশ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক আর্থিক লেনদেন চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশ সারের জন্য রাশিয়া ও বেলারুশের উপর নির্ভরশীল এবং যুদ্ধরত ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানি করতো। গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে পারেনি।
 
অন্যদিকে, কৃষ্ণসাগর তীরে অবস্থিত ইউক্রেনের প্রধান সমুদ্রবন্দর ওডেসা রুশ নৌবাহিনী অবরুদ্ধ করে থাকায় কিয়েভ থেকেও খাদ্যশস্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশে গমের সংকট তৈরি হয়। 

চাহিদা অনুযায়ী, সারের যোগান নিশ্চিত করা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ছিল সরকার।

এ অবস্থায় গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে, রাশিয়া থেকে সার, খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে তাদের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অন্যদিকে, জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলি থেকে আবারও খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু করেছে ইউক্রেন।

তাই রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সার ও গম আমদানি চূড়ান্ত করা হলেও, ডলারে অর্থ পরিশোধ করা যাবে কিনা– তা নিয়ে সংশয়ে ছিল সরকার।

এলসি কনফার্মেশন সম্পর্কে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, এখনও সুইফট ব্যবস্থায় যুক্ত এমন রাশিয়ান ব্যাংকের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় খোলা এলসি নিশ্চিতকরণ নিয়ে সমস্যা নেই।  জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে ডলারে গম ও সার আমদানির অর্থ পরিশোধেও কোনও সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে যেসব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেই দেশগুলোকে মস্কো 'আনফ্রেন্ডলি কান্ট্রি' (শত্রুভাবাপন্ন দেশ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শুধুমাত্র ওই সব দেশ রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস বা খাদ্যশস্য আমদানি করলে– তার মূল্য রুবলে পরিশোধ করার শর্তারোপ করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

'বাংলাদেশ ওই তালিকার বাইরে থাকায় এবং রাশিয়ান খাদ্যশস্য ও সার আমদানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা না থাকায়– ডলারে আমদানি করতে এলসি কনফার্মেশন করবে বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো। আফ্রিকার দেশগুলোও ডলারে রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করছে'- জানান তিনি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে এলসি খোলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। 

ব্যাংকটির বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন শাখার একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, রাশিয়ার সরকারি মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করেন তারা। ওই ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। এলসি কনফার্মেশনেরও প্রয়োজন হয় না। 

এমনকী যুদ্ধ শুরুর পরও লেনদেনে কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানান তিনি।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.