প্রবাসী কর্মীদের বীমা সুবিধা বাড়ছে
চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের আরও বেশি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে একটি নতুন বিমা প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা করছে। ২০২২ সালের শেষের দিকে বিদ্যমান বিমা পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে।
নতুন বিমা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা কর্পোরেশন। এ প্রকল্পের আওতায় থাকা একজন প্রবাসী সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা অঙ্ক পাবেন, যা আগে ছিল ৪ লাখ টাকা। পাশাপাশি প্রবাসী কর্মী বিমার মেয়াদ বর্তমানের দুই বছর থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে পাঁচ বছর। তবে কমানো হবে প্রিমিয়াম।
এর অর্থ, এই পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে এ বিমার আওতায় থাকা কোনো কোনো প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু, আহত কিংবা অঙ্গহানি হলে বিমা সহায়তা পাবেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা বিমার আওতা ও সুবিধা আরও বাড়াবেন।
'সরকার বিদেশ যাওয়া ও রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোকে মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করতে কাজ করছে। আমরা শিগগিরই নতুন বিমা নীতি বাস্তবায়ন করব,' যোগ করেন তিনি।
নতুন বিমা পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই বিমার এককালীন প্রিমিয়াম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। বর্তমানে এককালীন প্রিমিয়ামের পরিমাণ ৪৯০ টাকা।
দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা 'রেমিট্যান্স যোদ্ধা'দের বিশেষ সুবিধা দিতেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এমন বিমা পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে জীবন বীমা কর্পোরেশন।
বিদেশে যাওয়ার পর কোনো প্রবাসী ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরলে তাকেও বিমার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানটি।
তবে কী পরিমাণ কর্মী প্রতি বছর কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে আসেন, সে বিষয়ে তাদের কাছে সঠিক কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে জীবন বীমা।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে তথ্য পাওয়ার পরই নতুন বিমা পরিকল্পনা তৈরি করবে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১২ এপ্রিল প্রবাসী কর্মীদের প্রদত্ত বিমা সুবিধা নিয়ে পর্যালোচনায় এক সভার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ জুলাই নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেছে জীবন বীমা কর্পোরেশন। ওই সভায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল), প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় প্রবাসীদের বিমা অঙ্ক বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে জীবন বীমা কর্পোরেশনকে বিমা পরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়।
জীবন বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'প্রবাসীরা দেশের ডিগনিফাইড লোক। তারাই এখন দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদেরকে ভালো সুবিধা দিতেই নতুন বিমা পরিকল্পনা করা হয়েছে।'
কাজের উদ্দেশ্যে কোনো বাংলাদেশি বিদেশ গেলেই বাধ্যতামূলকভাবে প্রবাসী কর্মী বিমার আওতায় আসেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী কর্মীদের পক্ষে প্রিমিয়াম গ্রহণ করে জীবন বীমা কর্পোরেশনে জমা দেয়।
২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশগামী বাংলাদেশিদের বিমা সুবিধায় আনার নির্দেশনা দেন। ২০১৯ সালে তিনি প্রবাসী কর্মীদের জন্য বিমা স্কিমের উদ্বোধন করেন।
এরপর প্রবাসী কর্মীদের ঝুঁকি কমানো ও নিরাপত্তার স্বার্থে বাধ্যতামূলকভাবে বিমা সুবিধা চালু করে সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারের সবাই চাচ্ছে প্রবাসীদের আরও সুযোগ-সুবিধা দিতে।
কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের তথ্যানুসারে, শুরুতে এই বিমার প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল ৯৯০ টাকা। দুই বছর মেয়াদে এই বিমা অঙ্কের পরিমাণ ছিল ২ লাখ টাকা।
তবে প্রথম দফায় চুক্তি শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালে ডিসেম্বরে জীবন বীমার সঙ্গে নতুন চুক্তি করে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। তখন বিমার প্রিমিয়াম ৫০০ টাকা কমিয়ে ৪৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়; আর মেয়াদ দুই বছর রাখা হলেও বিমা অঙ্ক বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এই চুক্তির মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হবে। তারপরই নতুন বিমা পরিকল্পনায় নতুন চুক্তি হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসী কর্মীরা কী কী সমস্যার মোকাবিলা করছেন, সেগুলো চিহ্নিত করতে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রবাসীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকিং খাতের একটি প্রতিনিধি দল বিদেশের প্রধান কর্মবাজারগুলোত সফর করবে।
রেমিট্যান্স আয়কারীদের কল্যাণে সরকারের নানামুখী পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন আরও বলেন, 'বাংলাদেশের বিমানবন্দরে প্রবাসী কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করছি। বিদেশে মিশনগুলোও প্রবাসীদের কিভাবে আরও ভালো সেবার দিতে পারে, সেটার চেষ্টাও করছি।'
এছাড়া প্রবাসীরা দেশে আসা ও বিদেশে থাকার সময় সেবা, আইনগত সহায়তা দেওয়া, দেশে এলে ঋণের ব্যবস্থা করা, যাওয়ার সময় ঋণ সেবা চলমান রয়েছে। এই বিষয়গুলো কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, সেটা নিয়েও করছেন বলে জানান সচিব।
প্রবাসী কর্মী বিমার প্রিমিয়ামে বড় মুনাফা
প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ কর্মী বিদেশে যান। ২০১৯ সালে বিমা চালু হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে ৪৯০ টাকা প্রিমিয়াম পাচ্ছে জীবন বীমা কর্পোরেশন।
বিদেশগামী কর্মীদের বড় অংশই যেহেতু বয়সে তরুণ, তাই বিমা দাবির পরিমাণ খুবই কম। যার ফলে প্রবাসী কর্মী বিমা পরিকল্পনা থেকে প্রতি বছর বড় মুনাফা করছে জীবন বীমা কর্পোরেশন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই সময়ে ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭৩ জন কর্মীর প্রিমিয়াম হিসাবে জীবন বীমা কর্পোরেশন পেয়েছে ৫৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যার বিপরীতে ১০৩ প্রবাসী কর্মীর ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিমা দাবি পরিশোধ করেছে জীবন বীমা।
জীবন বীমার এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশে কোনো প্রবাসীর মৃত্যু হলেই কেবল বিমা দাবির আবেদন আসে। কোনো কর্মী গুরুতর আহত কিংবা অঙ্গহানি হলেও সাধারণত আবেদন আসে না।
কারণ হিসাবে ওই কর্মকর্তা না না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে জানান, 'অসুস্থ বা আহতরা বিদেশে থাকায় বিমা দাবি আবেদন করেন না। আবার কেউ করলেও সেটা যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিমা দাবিকে আমরা গুরুত্ব দিই।'
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার টিবিএসকে বলেন, সরকার প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই তাদের বিমার প্রিমিয়াম কমানোসহ মেয়াদ ও বিমার অঙ্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে প্রবাসী কর্মীরা যাতে এর সুফল পান, সেজন্য এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
তিনি বলেন, বিমা সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়া বা বিমা দাবি করার প্রক্রিয়া অনেক সহজ করতে হবে, যাতে প্রবাসী কর্মী বা তার পরিবার খুব সহজে হয়রানিমুক্তভাবে বিমা সুবিধা পেতে পারে।
সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রিমিয়াম পরিশোধ করলে বিমা সুবিধার ওপর প্রবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না উল্লেখ করে ড. আবরার বলেন, প্রবাসী কর্মী যখন প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন, তখন এই বীমার ওপর তার অধিকার জন্মায়। তাই ন্যূনতম প্রিমিয়াম নেওয়া যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।