ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের চাহিদা কমেছে ৩০ শতাংশ, কাজ হারিয়ে বিপাকে শ্রমিকরা

বাংলাদেশ

18 August, 2022, 01:10 pm
Last modified: 18 August, 2022, 01:22 pm
‘মন্ত্রীরা তামাশা করে আমরা নাকি বেহেশতে আছি। তারা থাকতে পারেন, আমরা নেই। সব কিছুর দাম বাড়িয়ে আমাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে।'

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকেই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের চাহিদা ৩০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এই সময় অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়ে সংকটে পড়েছেন।

সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড গিয়ে দেখা যায় পুরো স্ট্যান্ড ভরে রয়েছে গাড়িতে। এছাড়া স্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়কগুলোতেও ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ পার্কিং করে রাখা। অলস বসে রয়েছেন শ্রমিকরা।

তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের শ্রমিক মনির হোসেইন ৩ দিন ধরে কাজ পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, আমাদের আয় কমে গেছে কিন্তু ব্যয় বেড়ে গেছে। ডাল, আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে দিন কাটাতে হয় এখন।

মনির হোসেইন বলেন, হোটেলে আগে মাছ ভাত ৬০ টাকায় খাওয়া যেত। এখন আলু ভর্তা, ডাল ও শাক দিয়ে খেতেই ৬০ টাকা লাগে। আলু ভর্তা ছিল ৫ টাকা, সেটা এখন হয়েছে ১০ টাকা, ডাল আগে ফ্রি দিত এখন ১০ টাকা নেয়। ভাতের প্লেট ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করেছে ২০ টাকা। গরুর মাংসতো খেতেই পারি না। মাছ ও মুরগির মাংস সপ্তাহে দুই দিন খেতাম সেটা এখন দাম বাড়ার কারণে খাওয়া হয় না। ছোট একটুরো মাছ ৫০ টাকা ছিল, সেটা হয়েছে ৮০ টাকা। মুরগির টুকরো ছিল ৬০ টাকা সেটা হয়েছে ১০০ টাকা। কাজ পেলে ৫০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে পরিবার ঢাকায় রাখা সম্ভব না। তাই ঈদের আগে তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালে পাঠিয়ে দিয়েছি। ছেলে নবম শ্রেণীতে পড়ে। টাকার আভাবে ওকেও গত সপ্তাহে দেয়ালে রং দেয়ার কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। জানি না ছেলের আর পড়া হবে কি না।

মনির হোসেইনের পাশেই বসে ছিল প্রায় ১০ জন শ্রমিক, তারাও কাজ পাচ্ছেন না ৩ দিন ধরে।

মোহম্মদ ফরহাদ বলেন, 'মন্ত্রীরা তামাশা করে আমরা নাকি বেহেশতে আছি। তারা থাকতে পারেন, আমরা নেই। সব কিছুর দাম বাড়িয়ে আমাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে। ৬ মাস আগেও ভোলা থেকে ঢাকায় আসতাম ৩০০ টাকায় সেটা এখন হয়েছে ৫০০ টাকা। খরচ চলাতে না পেরে গতমাসে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখনতো টাকার অভাবে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেও পারছি না।

তেজগাঁওয়ে গ্যারেজে কাজ করে মোহম্মদ আকাশ। তিনি বলেন, গাড়ি কম চলাতে গ্যারেজে কাজও কমে গেছে। সকালে শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে বের হয়েছি। ডিমের দাম যে হারে বেড়েছে কেনার সাহস পাই না। আগে ডিম ভাজি, আলুভর্তা ডাল দিয়ে সকালে ভাত খেতে পারতাম।

মোহম্মদ আকাশ মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। বেতনের অর্ধেকের বেশিই চলে যায় বাড়ি ভাড়াতে। স্ত্রী ও মাকে নিয়ে মগবাজার এলাকায় থাকেন ৬ হাজার টাকা দিয়ে।

আকাশ বলেন, আগে সপ্তাহে একদিন ফার্মের মুরগি আর ৪ দিন ডিম রান্না হতো। এখন আলু ভর্তা, সবজি আর ডাল দিয়েই খেতে পারছি না। কার্ড সিস্টেম করার কারণে টিসিবির পণ্যও আমরা কিনতে পারছি না। সরকারের উচিত আমাদের জন্য কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার ব্যবস্থা করা।

মোহম্মদ মহসিন ছোট কাভার্ড চালান। বেগুনবাড়ি এলাকায় ৬,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, আগের মতো এখন কাজ নেই। বেকার বসে থাকতে হয়। গাড়ি চালালে এক হাজার টাকা আয় হয়। সেখান থেকে দুই বেলা হোটেলে খেতেই চলে যায় ৩০০ টাকা। আগে ২০০ টাকায় খেতাম। ছয় মাস আগেও পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে ভালোই ছিলাম। দেশি মুরগিও কিনেছি সেই সময়। এখনতো ফার্মের মুরগিই কিনতে পারছি না। গতকাল আমার ৭ বছরের ছেলে ডিম খেতে চেয়েছে। একটি ডিম কিনেছি ১৫ টাকা দিয়ে।

বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভারস ইউনিয়নের সাবেক সহ-সভাপতি ও একতা ভাই ভাই ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সত্ত্বাধিকারী হারুন-উর রশিদ বলেন, তেজগাঁওয়ে ৮ থেকে ৯ হাজার গাড়ি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে ৩০ শতাংশ ট্রিপ কমে গেছে। গার্মেন্টস পণ্য চট্টগ্রামে নেওয়ার জন্যও আগের মতো চাহিদা নেই। যারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় সবজি নিয়ে আসতো তারাও হয়তো খরচ বেশি পড়বে দেখে ঢাকায় পণ্য আনা কমিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় বাজারেই বিক্রি করছে দাম একটু কম পেলেও।

হারুন উর রশিদ বলেন, কাভার্ড ভ্যানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ১৩ টনের পণ্য নিয়ে যাওয়া-আসায় ১৩০ লিটার তেল প্রয়োজন হয়। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করেছে। এখন আমাদের শুধু তেল খরচই হয় ১৪,৩০০ টাকা। আমাদের তেল খরচই বেড়েছে ৪ হাজার ৪২০ টাকা। তবে সেই অনুযায়ী বাড়তি ভাড়া পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, সড়ক পরিবহনের চালক-শ্রমিক ৭০ লাখ ও নৌ পরিবহন শ্রমিক ২০ লাখ ।

জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। এ বাড়তি দামের কারণে সংসার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের এ মানুষগুলো।

বলাকা এক্সপ্রেস বাসের কন্ডাক্টর ফারুক আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আমাদের এখন আয় কম হয়। মাসে ২০ দিন কাজ তাকে। আগে ১,০০০ টাকা পেতাম দৈনিক, এখন পাই ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

আগে সপ্তাহে চার শুক্রবার মুরগির মাংস খেতাম এখন দুই শুক্রবার খাই। পরিবার নিয়ে টঙ্গি এলাকায় থাকি সেখানেও বাসা ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে সাপ্লাই চেইন উন্নত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে কর সমন্বয় বা আমদানির মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।

'এই সময়ে এসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক নয়। সরকারের মুনাফা করার কথা ভাবা উচিত নয়। তাদের তো জনগণের সেবা করার কথা। সর্বশেষ পরিবহন খরচের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে, নিম্নআয়ের মানুষ তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সংগ্রাম করছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখন চাপের মধ্যে রয়েছে,' বলেন তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.