খাদ্যতালিকা থেকে ডিমও বাদ দিয়েছেন বস্তিবাসীরা

বাংলাদেশ

17 August, 2022, 11:45 am
Last modified: 17 August, 2022, 12:42 pm
"মাঝে মাঝে ডিম এনে সবজির মধ্যে দিয়ে রান্না করে খেতাম কিন্তু এখন সেটাও বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি। গত রাতে পানি খেয়েই ঘুমাতে হয়েছে। এতো খরচ চালিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো সেটাই জানি না।" 

রাজধানীর কল্যাণপুর বস্তির প্রায় ৩০ বছরের বাসিন্দা সাফিয়া খাতুন (৬৫) বিভিন্ন সময়ে নানান প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও এখনকার মতো দুরবস্থায় পড়েননি কখনও। 

সাফিয়া খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলছিলেন, "হঠাৎ করে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। তিন বেলা খেতে পারি না, এক বেলা রান্না করে দুই বেলা খেয়ে দিনযাপন করছি। করোনা আসার পরে কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংস খেতে পারতাম না তবে ডিম সপ্তাহে ২/৩ দিন খেতে পারতাম।" 

"এখন ডিমের দাম বাড়ার পরে গত ১০ দিন ধরে ডিমও বাদ দিয়েছি খাবার তালিকা থেকে। শাক, আলু ভর্তা আর ডাল দিয়েই খাচ্ছি দুই বেলা। বাজারে ২০ টাকার নিচে কোনো শাকও পওয়া যায় না।" 

বস্তির ছোট একটি ঘরে ছোট ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনীকে নিয়ে থাকেন তিনি। করোনার পর গৃহকর্মীর কাজ হারিয়ে শাক তুলে এবং তা বাজারে বিক্রি করেন, দিন আয় হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। 

একই বস্তির আর এক বাসিন্দা ইয়ানুর বেগম টিবিএসকে বলেন, "বাসায় কাজ করে ১০ হাজার টাকা পাই এবং এ দিয়েই তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতে হচ্ছে। কোরবানি ছাড়া তো গরুর মাংস চোখেই দেখি না। সর্বশেষ কবে মুরগি খেয়েছি সেটাও খেয়াল নেই।" 

ইয়ানুর বলেন, "মাঝে মাঝে ডিম এনে সবজির মধ্যে দিয়ে রান্না করে খেতাম কিন্তু এখন সেটাও বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি। গত রাতে পানি খেয়েই ঘুমাতে হয়েছে। এতো খরচ চালিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো সেটাই জানি না।" 

"মাসে ঘর ভাড়াতেই চলে যায় ২২০০ টাকা। বাকি টাকা দিয়ে খাবার খরচ চালাতে হয়। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানো কিংবা ওষুধ খাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। করোনার আগে মাসে একবার গরুর মাংস, ২/৩ বার মুরগি এবং সপ্তাহে অন্তত দুদিন ডিম খাওয়া হতো। এরপরে করোনা আসায় মাসে একদিন মুরগি এবং নিয়মিত ডিম খেতাম কিন্তু গত ২/১ মাসে সেটাও পারছি না।" 

কিছুটা ভাঙা ডিম কিনেন তিনি এখন, ভাঙ্গা ডিম কিনতেও ১০ টাকা খরচ করতে হয়। 

"সবকিছুর এতো দাম বাড়লো কিন্তু আমাদের আয় ইনকাম তো বাড়েনি। সামনের দিনে না খেয়ে মরতে হয় কিনা কে জানে!" 

সোমবার রাজধানীর কল্যাণপুর বস্তি ঘুরে এখানকার অন্তত ৩৫ জন বাসিন্দার সাথে কথা বলে দেখা যায় শুধু সাফিয়া খাতুন কিংবা ইয়ানুর বেগমই নন অধিকাংশই তাদের খাবারের তালিকা থেকে অনেক আগেই বাদ দিয়েছেন মাংস। এখন মুরগি, মাছের পাশাপাশি ডিমও বাদ দিয়েছেন তারা। 

গত কয়েকমাস ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির কারণে সবাই-ই কাটছাট করেছিলেন খাবারের তালিকায়। তবে সেখানে সপ্তাহে অন্তত ১-২ দিন ডিম এবং মাসে একবার মাছ/মুরগি রাখতেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরে তাদের খাদ্য তালিকায় ডিমও রাখতে পারছেন না অনেকেই।

বস্তির বাসিন্দা কায়িক শ্রমিক মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, তার ৫ জনের পরিবারের একজন বাদে সবাই-ই ছোটখাট কাজ করে। এরপরেও মাসের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

"সপ্তাহে ১ দিন কাজ পেলে ২ দিন বসে থাকতে হয়। দৈনিক হাজিরা ৬০০ টাকার বেশি দেয় না। পরিবারের ৫ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জনে মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় করি। এ টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া, বিদ্যুত বিল, গ্যাস, চাল-ডালেই চলে যায় ২০ হাজার টাকার মতো। এখন এই দূরমূল্যের বাজারে শাক-সবজি, আলু ভর্তা আর ডাল খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি।" 

এ বস্তির অন্য এক বাসিন্দা আব্দুল মজিদ টিবিএসকে বলেন, "এক কোরবানি গেছে গরুর মাংস খেয়েছি আবার আল্লাহ বাঁচালে আগামী ঈদে খাবো। একটা ডিম এনে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। ২/৩ মাস পরে কোনো আত্মীয় আসলে ১-১.৫ কেজির মুরগী কিনি। ডিমের দাম বাড়ার পরে ডিম খাইনি।" 

গত চার-পাঁচদিন থেকে বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে আমিষের সবচেয়ে সস্তা উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের দাম। এই কদিনের মধ্যে হালিপ্রতি ডিমের দাম প্রথম ধাপে ৩৮-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪২-৪৪ টাকা, পরের ধাপে ৪৫-৪৮ টাকা এবং এরপর গিয়ে ৫০ টাকায় উঠেছে। শনিবার অবশ্য কিছু কিছু দোকানিকে এক হালি ব্রয়লার মুরগির ডিম ৫৫ টাকাতেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ একেকটি ডিম কিনতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ১২.৫০ টাকা থেকে ১৩.৭৫ টাকা।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) শনিবারের বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে,  এক মাস আগের দামের তুলনা করলে এখনকার দাম ১৫.৩৮ শতাংশ বেশি। আর একবছর আগের দামের সঙ্গে তুলনা করলে এটা ৩২.৩৫ শতাংশ বেশি। ঠিক এক বছর আগে এই সময়ে ব্রয়লার মুরগির প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয়েছে ৩৩-৩৫ টাকায়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.