ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানিতে বার্ষিক নির্ধারিত কোটা সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ

15 August, 2022, 12:40 am
Last modified: 15 August, 2022, 04:32 pm
ভারত তার অপর দুই প্রতিবেশী- মালদ্বীপ ও ভুটানেও বার্ষিক নির্ধারিত কোটা পদ্ধতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি করে।

আন্তর্জাতিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতার সময়ে বাংলাদেশের আমদানির জন্য চাল, গম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন অত্যাবশকীয় পণ্যে বার্ষিক নির্ধারিত কোটা (Annual fixed Quota) সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে ভারত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ৫-৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে যৌথ বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিতে পারে নয়াদিল্লি।

আমদানির কোটা সুবিধা ছাড়াও- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা এবং ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আগে বাংলাদেশের খোলা এলসির (ঋণপত্র) বিপরীতে গম সরবরাহ করার বিষয়ে ঘোষণা থাকতে পারে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন।

দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের আরও কিছু পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেওয়া এবং পাটপণ্যের ওপর বিদ্যমান অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ও থাকতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর উপলক্ষে ২৬ জুলাই নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান ভারতের বাণিজ্য সচিব বি. ভি. আর. সুভ্রামনিয়ামের সাথে সাক্ষাৎ করে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের খোলা ঋণপত্রের বিপরীতে গমের চালান ছাড় করতেও ভারতের বাণিজ্য সচিবের সমর্থন চান হাইকমিশনার। ইতঃপূর্বে ব্যবসায়ী থেকে সরকার পর্যায়ে (বিটুজি) বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠান- এগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড এবং বাগাদিয়া ব্রাদার্সের গম আমদানি চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তি সংক্রান্ত কূটনৈতিক নোটও ভারতের বাণিজ্য সচিবকে দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।

চাল, গম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশের ভারতের ওপর ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হলে কিংবা নিজ দেশে এসব পণ্যের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় রপ্তানি নিষিদ্ধ করায়– বাংলাদেশে এসব পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়।

যেমন ২০১৯ সালে ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর- বাংলাদেশে পেঁয়াজের কেজি প্রায় ৩০০ টাকায় উঠে। এর দু'বছর আগেও ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল, তখনও পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়েছিল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর চলতি বছরের মে মাসে ভারত গম রপ্তানিও নিষিদ্ধ করে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে গমের সংকট দেখা দেয় এবং আটাসহ বেকারি পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়।

বিভিন্ন সময় ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশকে বেকায়দায় পড়তে হয়। এ কারণেই কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকারকে আগাম তথ্য দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভারত সরকারকে একাধিকবার অনুরোধ করেছেন। তার প্রেক্ষিতেই ভারত আমদানিতে কোটা সুবিধা দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

ভারত তার অপর দুই প্রতিবেশী মালদ্বীপ ও ভুটানেও বার্ষিক নির্ধারিত কোটা পদ্ধতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি করে। এই পদ্ধতিতে প্রতি অর্থবছর এসব দেশে কি পরিমাণ আলু, পেঁয়াজ, চাল, গমের আটা-ময়দা, ডাল ও ডিম রপ্তানি করবে- তার একটি গেজেট প্রকাশ করে ভারত। সাধারণত, অর্থবছরের শুরুতেই তা প্রকাশ করা হয়।

এর আওতায় স্থানীয় বাজারে কোনো পণ্যের সংকট দেখা দিলে, ভারত যদি সেটি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাও দেয় তারপরও অর্থবছর জুড়ে দেশ দু'টি ওই পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের স্থানীয় বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে পারে।

তাই ভারতের এমন পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা।

রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ/সেপা) নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আলোচনা বিষয়ক যৌথ অধ্যয়নের উপসংহার উল্লেখ করেন ভারতের বাণিজ্য সচিব। তিনি আরও ইঙ্গিত দেন, এই 'ভিভিআইপি' সফরের যৌথ বিবৃতিতে চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণাও থাকতে পারে।

মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা আরও লাভজনক হবে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় বাণিজ্য সচিব।

ঢাকা ও দিল্লির যৌথ সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের চূড়ান্ত খসরা প্রতিবেদন অনুসারে, বাণিজ্য চুক্তি হলে আগামী ৭-১০ বছরের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩-৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানি বাড়বে ৪-১০ বিলিয়ন ডলার।

ভারতে বাংলাদেশের কিছু পণ্যকে শুল্ক বা কোটামুক্ত সুবিধা দেওয়ার সম্ভাবনাও এর আওতায় থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির বাণিজ্য সচিব। তবে যেসব পণ্য শুল্ক বাধার সম্মুখীন তাদের ক্ষেত্রেই এমনটা করা হতে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক ও অশুল্ক বাধা থাকলে সে বিষয়েও বাংলাদেশি পক্ষকে জানাতে বলেছেন তিনি। ভারত এ ধরনের অনুরোধ বিবেচনায় নেবে বলেও জানান তিনি।

দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সাফটা অনুসারে, বাংলাদেশকে মাদক ও অস্ত্রসহ ২৫টি পণ্য বাদে সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে ভারত। তবে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনেরর অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) রয়েছে বলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন। বিশেষ করে, পণ্যের মান যাচাইয়ে বিএসটিআই সনদ গ্রহণ না করা এবং বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ভারতের নতুন কাস্টমস নীতি বাস্তবায়ন বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশ হাইকমিশন বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই বাংলাদেশের পাটপণ্যের উপর আরোপিত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত; যা দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ থাকতে পারে বলে ভারতীয় বাণিজ্য সচিবের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়েছেন হাইকমিশনার।

এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে পাটের সুতা, চট ও বস্তা আমদানির ওপর টনপ্রতি ১৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কারোপ করে ভারত।

এই শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য জুন মাসে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীকে পৃথকভাবে চিঠি পাঠিয়েছেন।

হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ টিবিএসকে বলেন, 'ভারত পেঁয়াজ, গম রপ্তানি বন্ধ করলে দেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা থাকলে এনিয়ে আর সংকট তৈরি হবে না; খাদ্যের একটা নিরাপত্তাও তৈরি হবে। তখন প্রয়োজন অনুযায়ী, ভারতের বাইরে কোনো উৎস থেকে কতটুকু আমদানি করতে হবে, সেটার পরিকল্পনাও আগেই করা যাবে'।

টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. শফিউল আতহার তাসলিম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আমদানির ২৫-৩০ শতাংশই ভারত থেকে আসে। এখানে কোটা সুবিধাটা থাকলে, আমরা অনেকটা নিশ্চিত থাকতে পারব। এই নিশ্চয়তাটুকু থাকলে আমরা ক্রাইসিসেও অনেকটাই নির্ভার থাকতে পারব, সরবরাহ চক্র ঠিকঠাক রাখতে পারব। সুতরাং এই চুক্তি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখবে'।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র এজিএম তসলিম শাহরিয়ার বলেন, 'অবশ্যই এটা ইতিবাচক উদ্যোগ। এতে আমরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তা পাব'। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.