চট্টগ্রামে চার দশকে ১২০টি পাহাড় বিলীন

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
13 August, 2022, 06:40 pm
Last modified: 13 August, 2022, 06:55 pm
“সিডিএ পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে। এই সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ১৫টি পাহাড় কাটার অনুমতি নেয় তারা। ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে শর্ত লঙ্ঘন করায় পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে ১০ কোটির বেশি টাকা জরিমানা করে। সিডিএ এই সড়ক নির্মাণের পর বায়েজিদ থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বাইপাস সড়কের আশপাশে পাহাড় কাটার উৎসব শুরু হয়ে যায়, যা বর্তমানে চলমান।”

গত চার দশকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১২০টির মতো পাহাড় বিলীন হয়ে গেছে। ৪০ বছর আগেও ২০০ পাহাড় ছিল, যার ৬০ শতাংশ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ইংরেজ শাসনের পর পাকিস্তানে ২৪ বছরে কমেছে পাহাড়ের সংখ্যা। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড়ের সবই বিলুপ্ত হয়েছে। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। এরপরের ১২ বছরে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন।

শনিবার (১৩ আগস্ট) দুপরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে পাহাড় ও নদী রক্ষার দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।

সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরসহ চট্টগ্রামের সকল পাহাড় সংরক্ষণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ এবং নদী রক্ষার দাবিতে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র এবং নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে তিনটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামান এবং বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এসএম সিরাজুল হকের গবেষণা প্রবন্ধের বরাত দিয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়'জ লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪.২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮.৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।

"সিডিএ পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে। এই সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ১৫টি পাহাড় কাটার অনুমতি নেয় তারা। ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে শর্ত লঙ্ঘন করায় পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে ১০ কোটির বেশি টাকা জরিমানা করে। সিডিএ এই সড়ক নির্মাণের পর বায়েজিদ থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বাইপাস সড়কের আশপাশে পাহাড় কাটার উৎসব শুরু হয়ে যায়, যা বর্তমানে চলমান।"

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, পাহাড়, নদী, সমুদ্র পরিবেষ্টিত এবং প্রাচ্যের রাণী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সেই জৌলুস এখন ধংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাহাড়গুলো প্রতিনিয়ত কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান নদী কর্ণফুলী, হালদা ও সাত নদী দখল, দূষণ, ভরাট, চর জাগা এবং পরিকল্পিত ড্রেজিং না করায় ভয়াবহ হুমকির মুখে। ইটপাথরের এই শহরের কাছে জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগর এলাকা ছিল একসময় পাহাড়ঘেরা নয়নাভিরাম গহীন সবুজে আচ্ছাদিত একটি অঞ্চল। সেখানে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় ছিল ৩ হাজার ১শ একর। কিন্তু গত ২ যুগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০জনের চিহ্নিত ভূমিদস্যু বাহিনী জঙ্গল সলিমপুর এবং আলিনগর এলাকার পাহাড় কেটে আলাদা এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। গড়ে তুলেছে দেশের ভেতরে আরেক দেশ। 

তাদের সহযোগী হিসেবে আছে আরও অন্তত ৩০০ জন দখলদার বাহিনী। এই ভূমিদস্যুরা ২০০০ সাল থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তখন সে দলের ব্যানার টাঙিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করেছে। তারা প্রতিনিয়ত সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে হাজার হাজার ছিন্নমূলবাসীর কাছে ভাড়া কিংবা দখল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সে সাথে পাহাড়ের ভেতর ভূমিদস্যুরা গড়ে তুলেছিল অস্ত্র, সন্ত্রাস, মাদক ও চোরাচালানের ভয়ংকর কয়েকটি আস্তানা। এদের মধ্যে আবার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে প্রতিনিয়ত চলতো সংঘর্ষ, বন্ধুকযুদ্ধ, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, পাহাড় কাটার ফলে নদী-খাল ভরাট হচ্ছে। পানির ধারণ ক্ষমতা কমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগর দূষণ হচ্ছে। চট্টগ্রামের এখন যেসব পাহাড় যে অবস্থায় আছে, এর বিবরণসহ তালিকা করা হোক। নিয়মিত মনিটরিং করা হোক। তাহেল পাহাড় রক্ষা করা যাবে।

সংবাদ সম্মেলনের চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ উপস্থিত ছিলেন। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.