ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে যেভাবে বিস্তৃতি ঘটছে আবাসন প্রকল্পের

বাংলাদেশ

02 August, 2022, 12:55 pm
Last modified: 02 August, 2022, 05:28 pm
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, এসব এলাকায় ইতিমধ্যে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে আবাসন কোম্পানিগুলোর।

পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি হওয়ায় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় বসবাসের জন্য ব্যাপকহারে আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠছে।

রাজধানীর পোস্তগোলার পর থেকে মাওয়া পর্যন্ত এবং ওপারে শরিয়তপুরের ভাঙ্গা এলাকা পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছে দেশের বেসরকারি আবাসন কোম্পানিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই প্লট বিক্রয় করছে। এছাড়াও ফ্ল্যাট, বাড়ি এবং ডুপ্লেক্স বাড়িও বিক্রয় করছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, এসব এলাকায় ইতিমধ্যে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে আবাসন কোম্পানিগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে রাজধানীতে সহেজেই যোগাযোগ করা যাবে বলে এসব এলাকায় সাধারণ মানুষের আবাসন চাহিদা বাড়ছে। আর এই চাহিদার কারণেই আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর এই চার জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রকল্প, প্রতিষ্ঠান, হাইটেক পার্কসহ ছোট-বড় নানা ধরনের কারখানাও গড়ে উঠছে। এসব কারখানা, প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে কাজ করা লোকজনেরও আবাসন চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে জমি কিনে বাড়ি বানাচ্ছে এই এলাকায়।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের সিরাজদিখান এলাকায় মূল সড়ক সংলগ্ন ৮০৩ একর জমি নিয়ে পদ্মা সেতুর ওপারে সবচেয়ে বড় প্রকল্প নিয়েছে আমিন মোহাম্মদ সিটি। সাতটি সেক্টরে ভাগ করা এই প্রকল্পে ২.৫ কাঠা, ৩ কাঠা, ৫ কাঠা, ১০ কাঠা এবং ২০ কাঠা পরিমাপের প্লট বিক্রয় হচ্ছে। প্রতি কাঠা জমি ১৫ থেকে ৩০ লাখ দরে বিক্রয় করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ওই প্রকল্পের কাছাকাছি ১৪৪ বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের 'দ্য ভ্যালি বাংলাদেশ' নামের আবাসিক প্রকল্প।

এসব প্রকল্পে সবুজায়নের পাশাপাশি থাকছে বড় খেলার মাঠ, শিশু পার্ক, ঈদগাহ মাঠ ও শপিংমল সহ সকলরকম নাগরিক সুবিধা।

আমিন মোহাম্মদের এক কর্মকর্তা জানান, এক্সপ্রেসওয়ের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প আমিন মোহাম্মদ সিটি। রাজধানীর কাছাকাছি হওয়ায় এখানে ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের মতিঝিল শাখার কর্মকর্তা হাসান ইমান সুমন, সম্প্রতি শরিয়তপুরের ভাঙ্গা এলাকায় কমফোর্ট আবাসন প্রকল্পে একটি প্লট কিনে ইতিমধ্যে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন।

হাসান ইমান সুমন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমার নিজ জেলা শরিয়তপুর। এখন পরিবার নিয়ে রাজধানীর মানিকনগর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। এখানে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা বাসাভাড়া দিতে হয়। একইসাথে পৃথক ইউটিলিটি চার্জ দিতে হয়।'

তিনি বলেন, 'এক হাজার স্কয়ার ফুটের ওই ভাড়া বাসায় আমার তিন বছর বয়সী ছেলের খেলাধুলার কোনো স্পেস নেই। তাছাড়া রাজধানীর যে পরিবেশ, এখানে আমরা একরকম জোর করে বা বাধ্য হয়ে বাস করি।'

'সেতু চালুর কারণে শরিয়তপুর থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টায় মতিঝিলে আমার কর্মস্থলে পৌঁছা যায়। এছাড়াও প্রাকৃতিক পরিবেশ। এক্সপ্রেসওয়ে এলাকা আধুনিক হচ্ছে, উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে। তাই কমফোর্ট আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পিত এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে বাড়ি নির্মাণ করছি। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ নির্মাণ কাজ শেষ হলে পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করবো।' 

একই কারণে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান এলাকায় যৌথভাবে ১০ কাঠার একটি জমি কিনেছেন নবাবপুর এলাকার মেশিনারিজ পার্টস ব্যবসায়ী আলী আহমেদ ও তার চার বন্ধু।

আলী আহমেদ টিবিএসকে বলেন, আরো চার বছর আগে বেশ কম দামে ওই জমিটি কেনা হয়েছে। সেখানে বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে আগামী বছরের জানুয়ারি নাগাদ।

তিনি বলেন, 'নবাবপুর এলাকায় ব্যবসা করলেও রাজধানীর রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। রামপুরা থেকে নবাবপুর যাওয়া-আসা করতে যে সময় ব্যয় হয়, সিরাজদিখান থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ও যাত্রাবাড়ির হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে নবাবপুর যাওয়া-আসায় প্রায় একইসময় ব্যয় হয়। আর এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাফিক জ্যামের ভয় নেই।'

'সিরাজদিখান এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সকল রকম সুযোগ-সুবিধা রাজধানীর চেয়ে বেশি। ফলে ওই জমি কেনা হয়েছে', যোগ করেন আলী আহমেদ।

কত বিনিয়োগ

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) টিবিএসকে বলেন, 'পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই অনেক আবাসন কোম্পানি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি একটি খুব সাধারণ বিষয় ছিল যে, এক্সপ্রেসওয়ে ও সেতু চালু হলেই ওইসব এলাকায় নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীর কাছাকাছি চলে আসবে সেতুর এপার-ওপারের চার জেলা।'

তিনি জানান, রিহ্যাবের প্রায় ২০০ সদস্য প্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যেখানে এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগ আরো বাড়বে। কারণ, সময়ের ব্যবধানে এইসব এলাকায় অভিজাত ও বিলাসবহুল আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। সেটি কেন্দ্র করে বিভিন্ন বড় আবাসন কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে। 

উল্লেখযোগ্য আবাসন প্রতিষ্ঠান

আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ ও আমিন মোহাম্মদ সিটি ছাড়াও প্রবাসী পল্লী গ্রুপ প্রায় ২০০ বিঘা জমির ওপর লৌহজং এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নিউ ঢাকা সিটি নামের একটি আবাসন কোম্পানি ১৫০ বিঘা নিয়ে সিরাজদিখান এলাকায় আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলছে। সেতুর মাওয়া প্রান্তে আগে এরকম রিডিম সিটি, সরকার সিটি, এশিওর লেক সিটি, মাতৃভূমি সিটি, সুমনা ডেল্টা টাউন, মডার্ন গ্রিন সিটি, আপন নিবাস, আকাশ গ্রুপের আবাসন প্রতিষ্ঠান, সাউথ ঢাকা আবাসন, নিউ ঢাকা সিটি, ইউরো মডেল টাউন, দক্ষিণ গ্রিন টাউন, জামিল সিটিসহ কেরাণীগঞ্জ, লৌহজং এবং সিরাজদিখান ও পদ্মা সেতুর উত্তর থানা এলাকায় প্রায় ১২৫টি আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে।

আবার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা, শরীয়তপুরের জাজিরা, ভাঙ্গা ও মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় প্রায় ৮০টি আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি।

মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) কাজী নাহিদ রসুল টিবিএসকে বলেন, 'আবাসন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই মুন্সীগঞ্জ জেলায়। কারণ এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে এই জেলা থেকে রাজধানী বেশ কাছেই মনে হবে।'

তিনি বলেন, 'আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্প শুরু করার আগে জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়েছে। আর যারা অনুমতি নেয়নি, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট কিনে ক্রেতারা যেন প্রতারিত না হয়, আমরা সেদিকে সতর্কতার সাথে নজর রাখছি।'

ক্রেতাদের বড় অংশ প্রবাসী ও ব্যবসায়ী 

সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুমন মিয়া টিবিএসকে বলেন, এসব এলাকায় যারা প্লট এবং ফ্ল্যাট কিনছেন তাদের মধ্যে বড় অংশ হলো ব্যবসায়ী। এছাড়াও প্রবাসীরা, বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ প্রবাসীদের নজর এখন এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় একটি ভালো আবাস তৈরি করা। দেশের দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার প্রবাসীরাও এসব আবাসন প্রকল্পে প্লট ও ফ্ল্যাট কিনছেন। আবার সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরাও অনেকে কিনছেন। 

শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ইসমাইল হক বলেন, 'এখন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বপ্নের মতো। তাই অনেকেই ঢাকা ছেড়ে এসব এলাকায় বসবাস শুরু করছে। সেই কারণেই আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় যতোরকম ব্যবসা এখন গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি।'

যেভাবে ভূমিকা রাখবে এসব আবাসন

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আর সেতু কেন্দ্র করে যে হারে আবাসিক প্রকল্প হচ্ছে সেটিও ওই এলাকার অর্থনীতি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কারণ যখন ওই এলাকায় কয়েক লাখ লোক নতুনভাবে বসবাস শুরু করবে, তা কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বাজার তৈরি হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, স্থানীয়দের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত সহজীকরণ হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এসব আবাসন কেন্দ্র করে। ফলে এলাকার ও দেশের অর্থনীতিতে ওই আবাসন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। 

তিনিও বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে যেসব ব্যবসা এখন পর্যন্ত গড়ে উঠছে, তার মধ্যে আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়।    

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.