ডিসেম্বর থেকে দেশের বায়ু বিদ্যুতে প্রথম বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটতে যাচ্ছে

বাংলাদেশ

22 July, 2022, 12:40 am
Last modified: 22 July, 2022, 12:20 pm
বাংলাদেশের মোট ৭২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র। এখানে দূষণমুক্ত শক্তিটি উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে এনার্জিট্র্যাকারএশিয়া’র এক প্রতিবেদন সূত্রে

আমদানিকৃত জ্বালানির সংকটে দেশে এখন লোডশেডিং করা হচ্ছে। কলকারখানায় সীমিত হয়েছে উৎপাদন কার্যক্রম। এই বাস্তবতায়- একটি ছোট অথচ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা জানা গেছে। তা হলো–চলতি বছর থেকেই আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হতে পারে জাতীয় গ্রিডে–কারণ ওই সময়েই দেশের প্রথম বৃহদাকার বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। 

তবে এটি দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প নয়। ২০০৫ সালে ফেনীর সোনাগাজীতে মুহুরী নদীর বাঁধ এলাকায় বায়ুভিত্তিক দশমিক ৯ মেগাওয়াট সক্ষমতার দেশের প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এর তিন বছর পর কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ১ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরেকটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তদারকি ও আগ্রহের অভাবে বর্তমানে দুটি কেন্দ্রেরই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। 

এবার কক্সবাজারে নির্মাণাধীন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার হওয়ায় তা প্রভাব সৃষ্টির মতো অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশের জন্য এ কেন্দ্রটির সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো–এটি কোনোপ্রকার আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল নয়–বরং বছরজুড়ে পাওয়া বায়ু প্রবাহকে ব্যবহার করেই এটি শক্তি উৎপাদন করবে। 

বাংলাদেশের মোট ৭২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র। এখানে দূষণমুক্ত শক্তিটি উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে এনার্জিট্র্যাকারএশিয়া'র এক প্রতিবেদন সূত্রে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির পক্ষের অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এটি। তাদের মতে, বাংলাদেশের  আছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা, যা এখনও অব্যবহৃত রয়েছে।    

চলতি বছরের ৩১ মার্চ ১১৬.৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের এই বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান- ইউএস-ডিকে গ্রিন এনার্জি (বিডি) লিমিটেড চীনা প্রতিষ্ঠান- এসপিআইসি উইলিং পাওয়ার কর্পোরেশনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এরমধ্যেই প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সমুদ্র উপকূলঘেঁষা কক্সবাজারের খুরুশকুল, পিএমখালী, চৌফলদন্ডী ও পোকখালী ইউনিয়নে এখন চলেছে উইন্ড টারবাইন বসানোর অপেক্ষা। গত শুক্রবার (১৫ জুলাই) তৃতীয় শিপমেন্টে প্রকল্পটির দুই সেট টারবাইনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে এসেছে বলেও জানান তারা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১৮ বছর মেয়াদি পরিচালনা চুক্তির আওতায়, এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রি করবে এর নির্মাণকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। 

ইউএস-ডিকে গ্রিন এনার্জি (বিডি) লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিচার্ড শিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'টাওয়ার বসানোর কাজ চলছে। মোট ২২টি উইন্ড টারবাইনের মধ্যে ৬টির ফাউন্ডেশন কানেকশন (ভিত্তি সংযোগ) শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। অন্য ৪টির ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে'।

এখন বর্ষার কারণে কাজ কিছুটা ধীর গতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ৪টি টারবাইনের ফাউন্ডেশন কানেকশনে আরও ৪৫ দিনের মতো সময় লাগবে। এরপর বাকী ১২টি টারবাইনের ফাউন্ডেশন কানেকশনের কাজ শুরু করা হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্ধারিত সময়েই যেন উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হয়, সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।

২০২৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে দেশের মোট বিদ্যুৎ সরববরাহের ১০ শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্যপূরণে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সরকার দেশে এক ডজন বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে, যা জাতীয় গ্রিডে ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নির্মাণাধীন কেন্দ্রটি এ ধরনের ৯টি বড় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে একটি, বাকিগুলোর কাজ একের পর এক শুরু করা হবে।  

কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় মোট ১০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরও তিনটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে, যা আগামী বছর শেষ হবে।

এ ছাড়া, চাঁদপুর সদরে ৫০ মেগাওয়াট এবং ফেনীর সোনাগাজীতে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঠিকাদার নির্বাচন পাইপলাইনে রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ মোট ২৭২ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও ছয়টি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে।

কক্সবাজার প্রকল্পের কাজ ক্রমশ এগিয়ে চলছে

মোট ২২টি উইন্ড টারবাইন– ১১০ মিটার লম্বা টাওয়ারের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্লেড বা পাখাগুলি বাতাসের শক্তিতে ঘুরে বায়ুশক্তিকে বিদ্যুতে পরিণত করবে। বাতাসে বিপরীতে এগুলি অনেকটা বিমানের ডানা বা হেলিকপ্টারের রোটার ব্লেডের মতো কাজ করে বলে কক্সবাজারের ৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন।

গত শুক্রবার তৃতীয় শিপমেন্টে প্রকল্পটির দুই সেট টারবাইনসহ ৯০০ টন যন্ত্রপাতি চীন থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। আগের দুটি চালান- একটি গত ডিসেম্বরে এবং অন্যটি চলতি বছরের মে মাসে আসে– ভিত্তি সংযোগের বোল্টসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মুকিত আলম খান টিবিএসকে বলেন, বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি সেকেন্ডে ৩ মিটার বাতাস প্রবাহিত হওয়া দরকার। আর সর্বোচ্চ ৯ মিটার বা তার বেশি বাতাস প্রবাহিত হলে- পুরো উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো যায়। 

নির্মাণাধীন বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থানটিতে গড়ে ৫.৫ মিটার বাতাস প্রবাহিত হয়। তবে শীতকালে বাতাসের বেগ কিছুটা কম থাকে বলে জানান তিনি। 

পরিবেশ-বান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা অধরাই রয়ে গেছে

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের অন্তত ৫ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক নিয়েছিল সরকার। এরপর ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। কিন্তু, কোনোটিই পূরণ করতে পারেনি। 

এখন সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। যদিও, বর্তমানে ৪ শতাংশের কম বিদ্যুৎ নবয়ানযোগ্য উৎস থেকে আসে। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন টিবিএস'কে বলেন, বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগকে দেশের জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনার দিক থেকে নতুন অধ্যায়ের সূচনাও বলা যেতে পারে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.