সংসদ সদস্যই মারধর করেছেন অধ্যক্ষকে, অডিও দিলেন আ.লীগ নেতা

বাংলাদেশ

রাজশাহী প্রতিনিধি
16 July, 2022, 07:40 pm
Last modified: 16 July, 2022, 07:49 pm
অডিওতে শোনা যায়, অধ্যক্ষ অন্যজনকে বলছেন, সেদিন এমপির অফিসে যাওয়ার জন্য অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল রাজু অন্য অধ্যক্ষদের ডেকেছিলেন।

রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীই কলেজ অধ্যক্ষ মো. সেলীম রেজাকে মারধর করেছেন। অধ্যক্ষ নিজেই এক ব্যক্তির কাছে মারধরের সেদিনের ঘটনার বর্ননা দিয়েছেন। আর তাদের দুজনের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেছেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।

সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী গত ৭ জুলাই তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনা জানাজানি হলে সারাদেশে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। 

১৪ জুলাই অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে নিয়ে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ওমর ফারুক চৌধুরী। সেখানে অধ্যক্ষ সেলীম রেজা দাবি করেন, সংসদ সদস্য তাকে মারধর করেননি। 

আর গোদাগাড়ীর মাটিকাটা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল রাজু দাবি করেন, এমপি না, তিনিই এমপির সামনে সেলীম রেজাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। এতে আলমারিতে ধাক্কা লেগে সেলীম আহত হয়েছেন। অধ্যক্ষ ফোরামের কমিটি গঠন ও টাকা-পয়সা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এ ঘটনা।

ওই সংবাদ সম্মেলনে এমপি ফারুক চৌধুরী দাবি করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনিই রটাচ্ছেন যে এমপি অধ্যক্ষকে মারধর করেছেন। 

তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিবাদে শনিবার সকালে নগরীর লক্ষ্মীপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেন, এমপির হাতে মারধরের শিকার হয়ে অধ্যক্ষ সেলীম রেজা তাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এ সময় তিনি এক ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যক্ষের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনান। কার সঙ্গে এই কথা হচ্ছে জানতে চাইলে আসাদ বলেন, 'সেটা এখন বলছি না।'

অডিওতে শোনা যায়, অধ্যক্ষ অন্যজনকে বলছেন, সেদিন এমপির অফিসে যাওয়ার জন্য অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল রাজু অন্য অধ্যক্ষদের ডেকেছিলেন। যার সঙ্গে কথোপকথন সেই ব্যক্তি অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেন, তারপরে আপনি গেলেন? 

অধ্যক্ষ বলেন, 'হ্যাঁ গেলাম। আমি তো এমনি যাই না, ডাকলে যাই। অন্যরা সাতদিনে তিনদিনই দেখা করে। আমি আর চব্বিশনগরের প্রিন্সিপাল হাবিব ভাই না ডাকলে, কোনো মিটিং না হলে যাই না। এটাও আবার রাগ। সেদিনও আমি আর হাবিব ভাই একসঙ্গে গেছি। এই দুইটা লোক ছাড়া ভাই সবাই ওর (এমপির) পা চাটা।'

অন্য ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, ওখানে যাওয়ার পরে? 

অধ্যক্ষ বলেন, 'ওখানে যাওয়ার পরে বিড়ইলের মজিবর ছিল। ওই যে স্কুল এমপিওভুক্ত হলো। ওরা ফুল-টুল নিয়ে গেছে। ওখানে সেক্রেটারি রশিদ ভাই (গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ) ছিল। ওরা বেরিয়ে আসলো। আমরা বসে ছিলাম। ৫-৭ মিনিট। তারপরে রশিদ ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক হলো। কথাবার্তা হলো। ওটা ওমর প্লাজার পূর্বপারে।

'তখন রাজু এসে বলছে, এই এমপি উঠে যাবে। ঢোকেন, ঢোকেন, ঢোকেন। সব ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই প্রথম কথা। আমাকে বলছে- সেলীম, তোমার কলেজে কি হয়েছে? আমি বলছি, কই স্যার? কিছু তো হয়নি। তখনই গালি (লেখার অযোগ্য) তোর অফিসে বসে আমার নামে, রাজুর পরিবার নিয়ে, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস, টিচাররা কথা বলে। তুই আমাকে না বলে, ওই টিচারদের বিচার না করে... এই উঠে এসেই মনে করেন যে কিল, ঘুষি লাথি।'

অধ্যক্ষ বলেন, 'বারবার উঠছে-বসছে, মারছে। হকিস্টিক ডেকে নিয়ে আসছে। পর্দা টেনে দিল। প্রিন্সিপালকে দিয়েই পর্দা টানাইছে। রাজু পর্দা টেনে দিল। দিয়ে বলছে, এই হকিস্টিক নিয়ে আয়। (গালি) হকিস্টিক দিয়ে মেরেই ফেলব। (গালি) আজ মেরেই ফেলবো, (গালি) আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। ...তো আমি তো নিজেই জানি না কখন এটা রেকর্ডিং হয়েছে, কী কথা হয়েছে।'

অন্য ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, 'কোন টিচার রেকর্ডিং করেছিল, তার কী নাম?' 

অধ্যক্ষ বলেন, 'সিরাজুল ইসলাম। তিনি আবার একজনকে চাকরি দিবেন বলে তিন-চার লাখ টাকা নিয়েছিলেন। রাজাবাড়ীর জনির কাছ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নিয়েছেন।

'জনি গত ১৯ তারিখে একটা দরখাস্ত দেন, স্যার সিরাজ স্যার আমার টাকা নিয়েছে। আপনি এটার বিচার করে দেন। আমাকে আর সভাপতিকে। এই সিরাজকে তখন আমি বলি, এই যে জনি আপনার নামে লিখিত দিয়েছে এটা বাইরে বাইরেই আপনি মিটআপ করে ফেলেন। তা না হলে আমি গভর্নিং বডিতে তুলব। 

'এ ঘটনার আগেই কিন্তু ওই রেকর্ডিংগুলো করে রাজুকে দিয়ে দিয়েছে আমাকে-টিচারদের ফাঁসানোর জন্যে।'

সেলীম রেজা আরো  বলেন, 'আমি ওই টিচারদের বিচার করলাম না কেন? কিন্তু আমি তো জানিই না ওটা রেকর্ড হয়েছে। এখন আমরা পাঁচজন বসলে একটা কথা হয় না? বিএনপি, জামাত, আওয়ামী লীগ নিয়ে হতে পারে। কোনো ব্যক্তি নিয়ে হতে পারে। এরমধ্যেই যদি কেউ রেকর্ডিং করে নিয়ে চলে যায়, ওখানে যে প্রধান বসে আছে সে কি বুঝতে পারবে?'

অধ্যক্ষ আরও বলেন, 'ও (সিরাজুল ইসলাম) এটা দেখে ৩০ তারিখে জনির ৮০ হাজার টাকা শোধ করেছে। ও গিয়ে আবার রাজুকে (অধ্যক্ষ রাজু) বলেছে, আপনাদের উপকারের জন্য এই রেকর্ডিংগুলো দিয়েছি। কিন্তু প্রিন্সিপাল মহোদয় এ কারণে আমাকে শোকজ করেছেন।'

ফোনের ওপাশ থেকে অচেনা ব্যক্তিটি তখন বলেন, 'তাহলে ওগুলো আলোচনা না, আলোচনা আপনাকে মারা?' 

অধ্যক্ষ বলেন, 'হ্যাঁ মারা।' 

ওই ব্যক্তি জানতে চান, প্রিন্সিপালদের ভূমিকা? 

সেলীম রেজা বলেন, 'কোনো ভূমিকা না, আমাকে বলছেন- মাফ নেন, মাফ নেন। তো আমি কীসের মাফ নিব? তারপরও বললাম, তো স্যার আমি তো জানি না, যদি আমার টিচাররা ভুল করে থাকে আর হবে না। এই "যদি" লাগিয়েছি দেখে আরও রাগ। উঠে আবার মার। প্রায় ১০ মিনিট।'

এই কথোপকথনের বিষয়ে কথা বলতে শনিবার সকালে অধ্যক্ষ সেলীম রেজাকে দুবার ফোন করা হলে প্রতিবারই তিনি ফোন না ধরে কেটে দিয়েছেন। দুপুরে তাঁর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। তাই এ বিষয়ে তাঁদের মন্তব্য জানা যায়নি।

সংবাদ সম্মেলনে আসাদ আরও বলেন,'ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ সেলীম রেজা মারপিটের ঘটনার পর আমার কাছে স্বীকার করেছেন। তাঁর শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাতপ্রাপ্তের প্রমাণ রয়েছে। ফারুক চৌধুরীর ভয়ে তিনি এখন কথা ঘুরিয়েছেন। এমপি ফারুক চৌধুরী রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ভোটার। গোদাগাড়ীর সকল মাদক ব্যাবসায়ীদের তিনি আশ্রয় প্রশয় দেন। তার বিরুদ্ধে দুদক ২০২০ সালে তদন্ত শুরু করে। সে সময় অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষক দিয়োগ দূর্নীতি-জামায়ত বিএনপি ব্যক্তিদের নিয়োগসহ ২০ ধরনের দূর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। এর আগেও তিনি কয়েকজন শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করার নামে তিনি কোটি কোটি টাকা শিক্ষকদের কাছে থেকে নিয়েছেন।' 

এদিকে অধ্যক্ষকে পেটানোর ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবার থেকেই সরেজমিনে তদন্ত করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। শনিবার কমিটির প্রধান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন বলেন, 'এ বিষয়টা আমরা সিরিয়াসলি তদন্ত করছি। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। আমরা কাজ করছি।' 

এ পর্যন্ত তদন্তে কী পাওয়া যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা তদন্তের স্বার্থে এখনই বলছি না। তবে এটুকু বলতে পারি- তদন্ত প্রতিবেদনে ভালো কিছুই উঠে আসবে। সঠিক বিষয়টা থাকবে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.