কর্ণফুলী টানেল: প্রবৃদ্ধির এক সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল
চট্টগ্রাম বন্দর ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্তকারী কর্ণফুলী টানেল বন্দর নগরীর দক্ষিণাঞ্চলকে যেমন একটি ব্যবসায়ীক কেন্দ্রে পরিণত করবে, তেমনি দূরত্ব কমাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে। চালু হওয়ার পর প্রবৃদ্ধির একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করবে এই টানেল।
ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে টানেলের প্রায় ৮৭ শতাংশ কাজ। পাশাপাশি টানেলের উভয়প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও ফ্লাইওভারের কাজও প্রায় শেষ।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এই টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠছে বড় বড় শিল্প কারখানা। যা বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে উন্মোচন করতে যাচ্ছে ব্যবসার নতুন দিগন্ত।
বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা; আসছে নতুন বিনিয়োগ। আবার পুরনো অনেক কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনেক বড় বড় শিল্প গ্রপ ইতোমধ্যেই কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে কিনে রেখেছেন আগাম জমি। সব মিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপে আনছে বড় ধরনের পরিবর্তন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দেশের নতুন বিজনেস হাব।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিজিএপিএমইএ এবং স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত চার বছরে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত ৮০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।
টানেলকে কেন্দ্র করে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে একটি ইস্পাত কারখানা ও অক্সিজেন প্লান্ট চালু করেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প পরিবার মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। এইচ এম স্টিল কারখানা ও এইচ এম অক্সিজেন প্লান্ট নামের প্রতিষ্ঠান দুটিতে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করছে।
এছাড়া কর্ণফূলী ও আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষে জমি ক্রয় করেছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ।
ইতোমধ্যে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- কর্ণফূলী উপজেলার জুলধায় সুপার ফার্মাসিক্যাল লিমিটেড, পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেড, একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিস লিমিটেড, বিএন লুব্রিকেন্ট।
কর্ণফুলীর খোয়াজনগর ও ইছানগর এলাকায় উৎপাদন শুরু করেছে বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল, ইউসা ব্যাটারি ফ্যাক্টরি।
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ রোড সড়কের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচ এস কম্পোজিড টেক্সটাইল। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠতে যাওয়া ওই পোশাক কারখানায় তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আধ কিলোমিটার দুরত্বে প্রায় পাঁচ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সাদ মুসা শিল্পপার্ক। যেখানে রয়েছে কটন মিলস, টেক্সটাইল মিল, স্পিনিং মিলস ও কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসসহ বেশকিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
টানেল চালুর পর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এভাবেই শিল্পয়নে মুখর হচ্ছে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়; যাতে এক সময়ের গ্রামগুলো পরিণত হচ্ছে উপশহরে।
বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদক দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফূলী ও আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এসব দৃশ্য দেখতে পান।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। এ টানেল মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। শুধু আনোয়ারা বা কর্ণফুলীই নয়, মিরসরাই থেকে নদীর পার ধরে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এদিকে কেইপিজেড, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি ও সিইউএফএল এর পাশাপাশি গড়ে উঠা নতুন নতুন শিল্প কারখানাকে কেন্দ্র করে আনোয়ারার চাতুরি চৌমুহনী ও বন্দর সেন্টার এলাকায় গড়ে ওঠেছে অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট, আধুনিক হোটেল-মোটেল। স্থানীয়রা মনে করেন বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, চায়না ইকোনেমিক জোন বাস্তবায়ন ও পিএবি সড়কের চার লাইনের কাজ এবং টানেলমুখি ছয় লেনের মহাসড়কের কাজ সম্পুর্ণ হলে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র পাল্টে যাবে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) বলছে, টানেলটি আনোয়ারাকে বন্দর নগরীর সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং রাজধানী ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব এবং চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এ টানেল চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। নদীর দক্ষিণ পাড়ের মানুষের জন্য সহজ হবে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে শুরুতে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পায়ন হবে। টানেলের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, বে টার্মিনাল, মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের মধ্যে সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠবে। তবে টানেলের প্রভাব হবে আরো সূদুরপ্রসারী। এটি মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প করিডর গড়ে তুলতে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে; পাশাপাশি এটি হবে এশিয়ান হাইওয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।"
বর্তমানে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারমুখী পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল করে শাহ আমানত তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু ও কালুরঘাট সেতু দিয়ে। আবার দেশীয় নৌকায় করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ কর্ণফুলী নদী দিয়ে যাতায়াত করে। টানেল চালু হলে শুরুতে কর্ণফুলী সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের একাংশ সেতুর বদলে টানেল দিয়ে চলাচল করবে। এরসঙ্গে যুক্ত হবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়ি।
দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ মোস্তফা-হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সারওয়ার আলম টিবিএসকে বলেন, "এখানে উৎপাদিত মালামাল সারা দেশে যায়। টানেল হয়ে গেলে আউটার রিংরোড হয়ে মালামালবাহী গাড়ি সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে চলে যেতে পারবে। এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঁচবে পরিবহন খরচও।"
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "আশা করছি আগামী বছরই আমরা টানেলের সুফল পেতে যাচ্ছি। শিল্পকারখানার কাঁচামাল আনা-নেওয়া এবং প্রস্তুত পণ্য সারাদেশে পরিবহনের সহজ মাধ্যম হবে এই টানেল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এখন নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে কোনো বাধা থাকবে না। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল ও চট্টগ্রাম বন্দর—এই দুই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে টানেলটি।"
এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত বলেন, "দক্ষিণের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আমরা টানেলের এপ্রোচ সড়কের পাশেই একটি ডিস্টিবিউশন হাউজ গড়ে তুলেছি। যেখান থেকে ইউনিলিভার ও মেরিকো কোম্পানিকে কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়। এর বাইরেও আমরা টানেলের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি।"
বিজিএমইএ এর সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, "বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের পোশাক খাতে নতুন বিপ্লব নিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে কোরিয়ান ইপিজেডে চারটি নতুন কারখানা কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আরও নতুন নতুন উদ্যোক্ত সেখানে কারখানা গড়ে তোলার অনুমতি চাইছে। অন্যদিকে টানেলের পাশেই গড়ে উঠতে যাওয়া চায়না ইপিজেডে দেশি-বিদেশি ১৫ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে চট্টগ্রামে নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় বাধা হলো গ্যাস সংযোগ। নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেওয়া না হলে ব্যবসায়ীরা সারভাইভ করতে পারবেন না।"
টানেলের অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ, আরও ছয়মাস সময় চায় টানেল কর্তৃপক্ষ
১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল টানেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত আরও ৬ মাস সময় দীর্ঘায়িত হলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় হবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) টিবিএসকে বলেন, "মে পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত একমাসের অগ্রগতি মিলিয়ে তা প্রায় ৮৭ শতাংশ। পাশাপাশি টানেলের উভয়প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও ফ্লাইওভারের কাজ প্রায় শেষ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলটি চালুর লক্ষমাত্রা সামনে রেখে কাজ করছি।"
"তবে আমরা এখনই বলতে পারছিনা ডিসেম্বরের আগে সব কাজ শেষ করা যাবে কি না; কারণ টানেলের অভ্যন্তরে কমিউনিকেশন সিস্টেমসহ ভেন্টিলেশন ও অন্যান্য কাজের সরঞ্জাম চীনের সাংহাই লকডাউনের কারণে আনতে বিলম্ব হচ্ছে। বর্তমানে কিছু যন্ত্রাংশ এলেও তা সরবরাহ হচ্ছে শ্লথগতিতে," বলেন প্রকল্প পরিচালক।
বুধবার কর্ণফুলী টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় টানেলের মুখ থেকে আনোয়ারার কালাবিবিরদীঘি পর্যন্ত সুদৃশ্য অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দক্ষিণ বন্দর এলাকায় চলছে ওজন স্কেল, টোলবক্স স্থাপনের কাজ। শেষ হয়েছে দক্ষিণ বন্দর এলাকায় ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজের কাজও। টানেলের পশ্চিমে পতেঙ্গা প্রান্তেও পুরোদমে এগিয়ে চলেছে সংযোগ সড়কের কাজ।
অপরদিকে, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া হাইওয়ে ক্রসিং থেকে আনোয়ারার চাতুরি চৌমুহনী পর্যন্ত ছয় লেনের মহাসড়ক তৈরির কাজ।
প্রকল্প পরিচালক জানান, বর্তমানে টানেলের প্রথম টিউবে পেভমেন্ট স্থাপন কাজ এগিয়ে চলেছে। এটি শেষ হলে দ্বিতীয় টিউবে পেভমেন্ট স্থাপন করা শুরু করা হবে। এছাড়া প্রথম টিউবে লেনস্ল্যাব স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় টিউবেও লেনস্ল্যাব বসানোর কাজ ৮০ শতাংশ শেষ।
টানেলে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য জেনারেটর স্থাপন, বাতাস ও অক্সিজেন পরিবহনের প্রযুক্তি স্থাপন, ডেকোরেটিভ ওয়াল, ফায়ার ওয়াল, ওপেন কাট এরিয়া, ছাউনিসহ কেবল লাইন ও লাইটিংয়ের কাজও চলছে। তবে এসব কাজের উপকরণ চীন থেকে আসতে দেরি হওয়ায় সম্প্রতি কাজের অগ্রগতি কমে এসেছে।
বাড়ছে জমির দাম, বদলে যাচ্ছে জীবনমান
টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আনোয়ারা-কর্ণফূলী অঞ্চলের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই বর্তমানে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মাত্র ২ শতাংশ জমি শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাকি প্রায় ৪৭ শতাংশ কৃষি জমি। তবে টানেলটি চালু হলে ওই এলাকার প্রায় ২৭ শতাংশ শিল্প উন্নয়নের ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সাত বছর পর, টানেল চালুর আগেই কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে জমিগুলো যেন সোনায় রুপ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই দেশের শীর্ষগ্রুপ এস আলম, আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপসহ শত শত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার একর জমি ক্রয় করেছেন গত তিন-চার বছরে। এতে আশপাশের জমির দাম বেড়েছে দশগুণের বেশি।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিনা সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়েক ডজন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে কর্ণফূলীর দক্ষিণ তীরে। এখানে এখন জমিন দাম এতটাই বেশি যে, দশগুণ দাম দিয়েও আপনি জমি পান কিনা সন্দেহ আছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও এই জমিগুলো অনাবাদি ছিল।"
টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়কের পাশেই চারতলা বাড়ি করেছেন প্রবাসী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, "টানেলের রাস্তায় আমার দুই গণ্ডা জমি ছিলো। এ জন্য আমি তিনগুণ দাম পেয়েছি। পাশাপাশি ধানি জমিগুলো কল্পনারও বেশি দামে কিনে নিয়েছে একটি শিল্প গ্রুপ। সে টাকাতেই আমি বাড়ি করেছি।"
ইতোমধ্যেই সরকার দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা লক্ষে আর্থিক ঋণ সহায়তার আওতায় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ৩২ হাজার ৪৬২ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন ব্যায়ে মহেশখালী, চকোরিয়া ও টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
টানেলের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজন আনোয়ারা-পেকুয়া সড়ক
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টানেলের সর্বোচ্চ সুফল পেতে আনোয়ারা-বাঁশখালী-কক্সবাজারের পেকুয়া পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন সময়ের দাবি। কিন্তু টানেলের কাজ শেষ হলেও সেই সড়কটির ব্যাপারে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অত্যন্ত জনগুরুত্বসম্পন্ন এই সড়ক প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে তা হবে দুঃখজনক।
স্থানীয় সমাজ কর্মী মোরশেদ নয়ন বলেন, "টানেল পাড়ি দিয়ে উল্টো আবার পটিয়ায় ঘুরে কক্সবাজার যাওয়া টানেলের উপকারিতা কমিয়ে দেবে।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহুবিধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। বাঁশখালীতে হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র। আনোয়রা থেকে কক্সবাজারের পেকুয়া পর্যন্ত সড়কটি হলে যোগাযোগ হবে সহজ, যা টানেলের সক্ষমতাকে পূর্ণতা দেবে।"
টানেল সংলগ্ন বারশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুম শাহ বলেন, "বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে আনোয়ারার পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে; বিশেষ করে পারকি সমুদ্রসৈকত পর্যটনের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কারণে আনোয়ারায় কৃষি ও মৎস্যজীবীরা অনেক বেশি উপকৃত হবেন। তবে টানেলের সড়কটি যদি বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার যেতো, তাহলে এই বিশাল এলাকার সবাই টানেলের সুবিধার আওতায় আসতো।"
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটির নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তখন ব্যয় একদফা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ধরা হয়।
প্রকল্পটির মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এটিই হবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত সুড়ঙ্গ পথ।