‘বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আটকে আছে’ ১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প

বাংলাদেশ

খোরশেদ আলম, বগুড়া
27 February, 2021, 03:30 pm
Last modified: 27 February, 2021, 03:31 pm
৩২ মাস ধরে সড়ক থেকে বৈদ্যুতিক খুঁটি সরাতে অসংখ্য চিঠি চালাচালি করা হয়েছে। তবুও হয়নি সমাধান। ফলে ‘খুঁটিতেই আটকে আছে’ এক হাজার ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের চার লেনের সম্প্রসারণ কাজ।

সড়কের চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় ৩৬ মাস। এর মধ্যে ২০ মাস পার হয়ে গেছে। এই সময়ে ৪০ শতাংশ কাজ হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১০ শতাংশ। কাজের এই ধীরগতির কারণ বৈদ্যুতিক খুঁটি। অথচ ৩২ মাস ধরে সড়ক থেকে বৈদ্যুতিক খুঁটি সরাতে অসংখ্য চিঠি চালাচালি করা হয়েছে। তবুও হয়নি সমাধান। ফলে 'খুঁটিতেই আটকে আছে' এক হাজার ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের চার লেনের সম্প্রসারণ কাজ। 

বগুড়ায় 'বনানী-মোকামতলা' অংশে ২৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে এমন সংকট সৃষ্টির অভিযোগ নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকারও করেনি নেসকো। ধীরে হলেও খুঁটি সরানোর কাজ চলছে বলে দাবি তাদের।

যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, সড়ক থেকে খুঁটি সরানোর বিষয়ে আড়াই বছর আগে থেকে অসংখ্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। মিটিংয়ে বসা হয়েছে একাধিকবার। এতেও কাজ হচ্ছে না। বগুড়ার প্রকল্প এলাকা থেকে যে খুঁটি সরেনি তা সরেজমিনেও দেখা গেছে।

দ্বিতীয় সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় এ কাজ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। উত্তরবঙ্গে শিল্প কারখানার প্রসারসহ ভারত-নেপালের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে চার লেন হচ্ছে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুর (রংপুরের মডার্ন মোড়) মহাসড়ক। রংপুর মহাসড়ক থেকে বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা হয়ে ভারত-নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মহাসড়কটি। ১৯০ কিলোমিটার সড়কে সম্প্রসারণে ২০১৬ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে কিছু সংযুক্তির ফলে বেড়েছে ব্যয়। এখন একই সড়কে নির্মাণ খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এই সড়ক মোট নয়টি ভাগে ভাগ করে উন্নয়ন কাজ চলছে।

অন্য অংশের কাজগুলো গতিশীল থাকলেও সংকট তৈরি হয়েছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বনানী থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা প্রকল্পে। এই অংশে ২৫ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়ক ফোর লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। প্রাথামিক অবস্থায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭১০ কোটি টাকা। তবে এখন তার সাথে আরও ৩১০ কোটি টাকা যুক্ত ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। বাড়টি টাকা দিয়ে কিছু আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।

সরকারি অর্থ বরাদ্দ ঠিকঠাক থাকলেও মূলত কাজ আটকে আছে বগুড়ার বনানী থেকে মাটিডালি পর্যন্ত সড়কে নেসকোর ৪৮৪ খুঁটির কারণে। আড়াই বছর ধরে চিঠি চালাচালি ও আনুষ্ঠানিক সভা করে এসব খুঁটি সরানো সম্ভব হয়নি।

বগুড়ার বানানী-মোকামতলা অংশে কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মানিকোজেবি কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম জানান, গত ২০ মাস আগে আমাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে করোনা ও বর্ষার কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল। কিন্তু প্রধান বাধা সৃষ্টি করেছে বৈদ্যুতিক খুঁটি। বনানী থেকে মাটিডালি অংশে অন্তত ৬০০ বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে। এগুলো সরানো হচ্ছে না বলে কাজও করতে পারছি না। আবার মাটিডালি থেকে গোকুল পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি। এই কারণে আমাদের অংশের কাজ ঝুলে আছে।

খুঁটি না সরানোর কারণে লোকসান হবে উল্লেখ করে এই প্রকৌশলী আরও বলেন, 'এই সময়ের মধ্যে আমাদের প্রকল্প অংশের কাজ ৪০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। বৈদ্যুতিক খুঁটি না সরানোর কারণে আমরা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারব না। গত ২০ মাস ধরে কাজ করতে না পারার কারণেই আমারা প্রায় ১২ কোটি টাকা লোকসানের মধ্যে পড়ব। খুঁটি সরানো না গেলে লোকসান ক্রমাগত বাড়বেই।'

তবে খুঁটি সরানো নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি নেসকো বগুড়ার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন ও সংরক্ষণ) মো. জাকির হোসেন। তবে নেসকোর প্রধান কার্যালয়ের (রাজশাহী) নির্বাহী পরিচালক (কারিগরি ও অপারেশন) প্রকৌশলী মো. আব্দুল আজিজ বলেন, 'সড়ক ও জনপদ এখনো পুরোপুরি সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। খুঁটিগুলো তুলে নতুন কোথায় বসাব, তারও কোনো নির্দেশনা তারা দেয়নি। আমরা তো খুঁটি তুলে পুকুরে বা গর্তে বসাতে পারি না। তারপরও আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি। আস্তে আস্তে কাজ হচ্ছে। একেবারে হচ্ছে না এমন বিষয় বলা যাবে না।'

তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরাবরই দাবি করে আসছে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটিগুলো সরানো হলেও নেসকোর বেলার সমস্যা প্রকট হয়েছে। এই কথাকে সমর্থন করেই এই প্রকল্পের (বানানী থেকে মোকামতলা) ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিব বলেন, 'খুঁটির কারণে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। একই সাথে মাটিডালি থেকে গোকুল পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে কিনা তাও এখনো বুঝে পাইনি। তবে সমস্যা বড় খুঁটি অপসারণ না হওয়া। এর কারণে ব্যয় বেড়ে গেলে সেটা তো সরকারকেই বহন করতে হবে।'

তবে এই সড়কে চাল লেনের জন্য জমি অধিগ্রহণ পুরোপুরি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মালেক। তিনি বলেন, 'মাটিডালি থেকে গোকুল পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণে একটু জটিলতা ছিল, তা সমাধান হয়ে গেছে। এটার জন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটছে বলে মনে করার কিছু নেই।'
 
জানতে চাইলে এই প্রজেক্টের মিডিয়া মুখপাত্র নির্বাহী প্রকৌশলী জয়প্রকাশ চৌধুরী বলেন, 'নেসকো লিমিটেড বগুড়াকে খুঁটি সরানোর জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা ২০১৮ সালের জুন মাসে পরিশোধ করা হয়েছে। ওই সময় থেকে তাদের খুঁটি সরিয়ে নিতে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের এমডি পর্যায়ে সরাসরি একাধিক মিটিং হয়েছে। তবে এতো কিছুর পরও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকেও নেসকোরে এমডিকে ফোন করা হয়েছে।' 

তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পের কাজ কয়েকটি জেলা মিলে হচ্ছে। অথচ বগুড়া নেসকো কোনোভাবেই আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছে না। অথচ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প এটি। এর কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজের খরচ বেড়ে গেলে সেটা আমাদেরই ক্ষতি হবে।

'এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ' প্রকল্পের কাজ ২০২১ সালের আগস্টে শেষ হওয়া কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পটি টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৪৬১ মিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি সেতু, ৪১১ মিটারের একটা রেলওয়ে ওভারপাস ও ১১টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু ইপিজেড ও গোবিন্দগঞ্জ পলাশবাড়ী এলাকায় নতুন করে দুটি ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ যোগ হয়েছে। 
              
ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ও বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়ক যুক্ত হতে যাচ্ছে। এই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। ১৯০ কিলোমিটার সড়কটি এর একটি অংশ। এই সড়কের মাধ্যমে রংপুর-সৈয়দপুর-বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেও রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের মুখপাত্র জয় প্রকাশ চৌধুরী।   

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.