‘নদী শাসন এখনো বিরাট এক চ্যালেঞ্জ’
অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে পদ্মার বুকে ৬.১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। সামনের দিনগুলোতে নদী শাসনই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে বলে মনে করেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সরকারি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "মূল সেতু নির্মাণ এবং নদী শাসনের কাজ শুরুর পর থেকেই নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে। কখনো পদ্মার ভাঙন, আবার কখনো কারিগরি জটিলতায় কাজ আটকে গেছে। মডিফাই করতে হয়েছে নকশায়। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।"
"পদ্মা বিশ্বের অন্যতম প্রমত্তা নদী। এই নদীর প্রবল স্রোত, বিপুল পরিমাণ পলিমাটির উপস্থিতি কাজের শুরু থেকেই সমস্যা হিসেবে ছিল।"
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ২০১৪ সালের নভেম্বরে কাজ শুরুর পরের বছরেই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালের দিকে স্রোতের কারণে মাওয়ায় নদীর তলদেশে গভীর খাদ তৈরি হয়। এ ছাড়া মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ভাঙনও দেখা দেয়। ফলে নদীশাসনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। এ বছরের ৩১ জুলাই মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন এরিয়ার কিছু অংশে ভাঙন দেখা দেয়। ওইদিন কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে থাকা অনেক মালামাল নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এই সমস্যা সামনের দিনগুলোতেও থাকবে।
এদিকে ২০১৭ সালে সেতুর খুঁটি বসানোর সময় ডিজাইনে থাকা ২২টি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। শুরুতে প্রতিটি পিয়ারের নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর কারণে খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। এতে বাড়তি সময় লাগে এক বছর। এ কারণে ওই সময় কাজের কিছুটা গতি হারায়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, "নভেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৭৬ শতাংশ। সেতু তৈরি পর্যন্ত শতভাগ নদী শাসনের কাজ শেষ হলেও নদী শাসনের চ্যালেঞ্জ একবারেই শেষ হবে না। ভবিষ্যতেও আমাদের এ কাজ করে যেতে হবে।"
তার মতে, এখন পর্যন্ত নদীর ওপরে সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ হলেও তার ওপরে আপার স্ল্যাব বসানো বাকি আছে। এপ্রোচ সড়কের সঙ্গে মূল সেতুর সংযোগ পুরোটা শেষ হয়নি। সার্বিক কাজের যে পরিমাণ বাকি আছে তা নির্ধারিত ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করাটাই হবে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ।
অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, "এখন আমাদের অনেকগুলো কাজ বাকি থাকছে। যেমন রোডওয়ে স্ল্যাব, (২৯১৭টির মধ্যে ১৩৩৩টি স্থাপন করা হয়েছে।), রেলওয়ে স্ল্যাব (২৯৫৯টির মধ্যে ১৯৪২টি বসানো হয়েছে), ব্রিজের রেলিং, স্ট্রিট ও আর্কিটেকচারাল লাইটিং, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করতে হবে।"
"নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে ঠিকাদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সবার প্রত্যাশা মতো দ্রুত কাজ শেষ করতে ঠিকাদারদের খুব বেশি চাপ দেওয়াও যাবে না। আমার মনে হয় ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মূল সেতুতে যান চলাচল শুরু করার যে চেষ্টা হচ্ছে তা কঠিন হয় যাবে।"
প্রকল্পে সরকারি বিশেষজ্ঞ দলের এই চেয়াম্যানের ভাষ্য, "নির্মাণ পরিকল্পনার পর থেকেই সমস্যা আমাদের পিছু ছাড়েনি। অর্থায়ন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস ও দক্ষ নেতৃত্বের কারণে আমরা তা জয় করতে পেরেছি।"
রেল সেতু নিয়েও কিছুটা জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ এলেও তা দ্রুতই সমাধান হয়ে গেছে বলে জানালেন তিনি।
"সেতু কর্তৃপক্ষ, ঠিকাদার এবং সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ, কর্মদক্ষতা এবং চেষ্টায় পদ্মা সেতুর কাজ এ পর্যন্ত এসেছে। এখন বাকি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাকিটাও শেষ হবে।"
তিনি মনে করেন আগের অভিজ্ঞতার আলোকে আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা খুব কঠিন হবে না।
নদী শাসনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠান। তারা এ বিষয়টি সফলভাবে করতে সক্ষম হবে। আর ভবিষ্যতেও এ কাজটি আমাদের অভিজ্ঞতায় করতে সক্ষম হবে।