হাতি ও বন্যপ্রাণীর জন্য হচ্ছে বনায়ন

বাংলাদেশ

আবু সাঈম, চট্টগ্রাম
24 June, 2020, 02:20 pm
Last modified: 28 June, 2020, 02:22 pm
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় প্রাথমিকভাবে ১৮০ একর এলাকায় এ প্রোটেক্টেড করিডর গড়ে তোলা হবে। দীর্ঘমেয়াদী এ বনায়ন বাস্তবায়ন হলে কমে আসবে হাতির মৃত্যু।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে একদিকে যেমন বনভূমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাসস্থান ও খাদ্য সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাবার সংকটে পড়েছে বিপন্ন এশিয়ান হাতি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে থাকা এ হাতির চলাচলের পথ (করিডর) বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও লোকালয়ে আসছে তারা। ফলে মানুষ হাতির দ্বন্দ্ব যেমন বাড়ছে তেমনি বিভিন্ন ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে বিপন্ন এ হাতি। গত আড়াই বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রাণ গেছে অন্তত ২৩টি হাতির।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্ট (আইইউসিএন) এর লাল তালিকার বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় আছে এশিয়ান এ এলিফ্যান্ট। তাই হাতিসহ বন্যপ্রাণীর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে বন বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেক্টেড করিডর বনায়ন করতে যাচ্ছে বন বিভাগ। এ করিডোরে লাগানো হবে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংস্থান হয় এমন উদ্ভিদ। 

এ ছাড়াও চট্টগ্রামে বন্যপ্রাণীদের উপযোগী বনায়ন করা হবে প্রায় দুই হাজার একর জায়গায়। দীর্ঘমেয়াদী এসব বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে লোকালয়ে এসে হাতি মৃত্যুর হারও কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ দুইটি রেঞ্জে ৮২৫ হেক্টর বা দুই হাজার ৬২ একর এলাকায় প্রায় ১২ লাখ চারা লাগানো হবে। এ মাসের মধ্যেই শেষ হবে এসব চারা লাগানোর কাজ। বন্যপ্রাণীর খাদ্যের উপযোগী প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ লাগানো হবে এ বনায়নে। 

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় প্রাথমিকভাবে ১৮০ একর বা ৭২ হেক্টর এলাকায় এ প্রোটেক্টেড করিডর গড়ে তোলা হবে। এর ১৫০ একর এরিয়ায় বন বিভাগ এবং বাকি ৩০ একর এরিয়ায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও এ বনায়ন করবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে প্রতি হেক্টরে ২৫০০ করে চারা হলে মোট এক লাখ ৮০ হাজার চারা বনায়ন করা হবে এ মৌসুমে। 

বন্যপ্রাণীর খাদ্য হিসেবে জারুল, তেলশুর, ছাপালিশ, বট, ঢাকি জাম, পুতি জাম, কালো জাম, গর্জন, বর্তা, কদম, বৈলামসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুখাদ্য সংশ্লিষ্ট এ বনায়ন করা হবে। 

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ন কবির বলেন, বিশেষ বন্য হাতিকে রক্ষায় আমরা ইতোমধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দক্ষিণ বনবিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের নাম হচ্ছে 'প্রটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডর বনায়ন'। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্য হাতি আর খাবারের সন্ধানে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না এবং তারা রক্ষা পাবে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের গড়ে তোলা নার্সারি। ছবি: সংগৃহীত

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের হিসাব মতে, ২০১৮ সাল থেকে চলতি জুন পর্যন্ত ২৩টি হাতি মারা গেছে। অন্যদিকে হাতি ও বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইই্উসিএন। তাদের হিসেব মতে গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মারা গেছে আটটি হাতি।
 
এ ছাড়াও ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে মারা গেছে ১১টি হাতি এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে মারা গেছে ছয়টি হাতি। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী ১৯৯২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে মারা গেছে ৯০টি হাতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ এবং পার্শ¦বর্তী বান্দরবানের লামা বনবিভাগের চকরিয়া-লামা সীমান্তের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় হাতি মারা গেছে। এ ছাড়াও সর্বশেষ গত ১৩ জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বৈলছড়ির অভ্যারখীল পাহাড়ে হাতিকে মেরে গোপনে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটে। 

আইইউসিএন'র কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রাকিবুল আমিন বলেন, হাতি মহাবিপন্ন প্রাণী। এমনিতে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয়টি হাতি মারা যাচ্ছে। কিন্তু গত ছয় মাসে মারা গেছে প্রায় আটটি হাতি। যা খুবই উদ্বেগজনক। 

''হাতিকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে। কিভাবে এ মহাবিপন্ন প্রাণীকে রক্ষা করা যায় সেদিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে হবে। তাই হাতির বাসস্থান ও বনের আশেপাশে যারা বসবাস করে তাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কিছু চিন্তা করা উচিত।'' এ ছাড়াও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া হাতিগুলো কীভাবে বনে নেওয়া যায় সে পরিকল্পনাও করতে হবে বলে জানান তিনি। 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কারণেও বাঁধাগ্রস্থ হবে ছয়টি করিডর। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ও রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের চলাচলের তিনটি করিডর ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। করিডর বাঁধাগ্রস্থ হওয়া এবং খাবার সংকটের কারণে নিয়মিতভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বিপন্ন এশিয়ান হাতি। ফলে বাড়ছে মানুষ হাতির দ্বন্দ্বও। 

চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, সুফল প্রকল্পের আওতায়ও চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও বন্যপ্রানী বিভাগে চুনতি ও জলদি রেঞ্জে বন্যপ্রাণীদের উপযোগী বনায়ন করা হচ্ছে। 

''গত আড়াই বছরে চট্টগ্রামে অনেকে হাতি মারা গেছে। ইলেকট্রিক শর্টের মাধ্যমে কিংবা ফাঁদে ফেলে এসব হাতির অধিকাংশই মারা হয়েছে। হাতিসহ যারা বিভিন্ন বন্যপ্রাণী শিকার করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এজন্য বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিনিধিদেরও কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।'' যোগ করেন তিনি। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.