সড়কে চুরমার দুর্জয়ের ভালো কলেজে পড়ার স্বপ্ন

বাংলাদেশ

30 November, 2021, 11:10 pm
Last modified: 30 November, 2021, 11:12 pm
এবার এসএসসি পরীক্ষা শেষে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। বাবার কাছে আবদার করেছিলেন, ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে।

প্রাণচঞ্চল উচ্ছল মাইনুদ্দিন মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছিলেন, 'ঠিক ততটা আঁধারে হারিয়ে যাব, যতটা অন্ধকারে হারালে কেউ সন্ধান পাবে না।' মা রাশেদা বেগম ছেলের কান টেনে ধরে জানতে চেয়েছিলেন, এসবের অর্থ কী? তার ছেলে দুর্জয় সত্যিই আধাঁরে হারিয়ে গেছে, তবে স্বাভাবিকভাবে নয়, নির্মম সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। 

প্রাণোচ্ছল দুর্জয়ের ফেসবুকের কভার ফটোতে বন্ধুদের সাথে জার্সি পরে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি। এক বন্ধু জানালেন, দুর্জয় ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। সবসময় ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতেন, আলোচনা করতেন। আবার মাঝে মাঝে দলবেঁধে খেলতেও যেতেন। 

ফেসবুকের প্রোফাইল ফটো দেখিয়ে তার বন্ধু আতিক বলেন, 'এই তো আমরা কয়দিন আগে আশুগঞ্জ ট্রেনে ঘুরে এসেছিলাম। সেই ছবিই ওর প্রোফাইল ছবি। আমরা সুযোগ পেলেই দলবেঁধে ঘুরতে যেতাম।'

সোমবার রাতে যখন রামপুরায় ডিআইটি সড়ক রণক্ষেত্র, পূর্ব রামপুরায় মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের বাসায় ঠিক তার উল্টো চিত্র। ছেলে হারানোর শোকে পাগলপ্রায় বাবা আব্দুর রহমান, তিতাস রোডের একতলা টিনশেড ঘরের সামনে পাটির বিছানাতেই বসে পড়েছেন। ক্ষণে ক্ষণে বুক চাপড়াচ্ছিলেন, আর যাকেই দেখছেন তার কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন। "তোমার ফোন থেকে একটা কল কইরা আমার মাইনুরে আইতে কও।" 

মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয় এবার এসএসসি পরীক্ষা শেষে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। বাবার কাছে আবদার করেছিলেন, ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। তবে বাবা আব্দুর রহমানের চায়ের দোকানের আয়ে টানাটানির সংসার। দুর্জয়ের বড় ভাই ভাড়ায় গাড়ি চালিয়ে ঘরে কিছু টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। 

আব্দুর রহমান সোমবার মধ্যরাতেও বলে যাচ্ছেন, "মাইনু রে, তোরে দরকার হইলে আমি ভিক্ষা কইরা পড়ামু। তবুও তুই ফিরা আয় বাপ।"  বলছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন। 

"মাইনু আমারে চা দোকানে হেল্প করত, মাঝে মাঝে লোকজনকে চা-ও বানাইয়া দিত। সোমবার রাতেও সে দোকান থেকে আমারে বলে গেল আধঘণ্টা পরে ফিরব। আপনারা এখন আমরা মাইনুরে আইন্যা দেন," দুর্জয়ের বাবা বলেন। 

পূর্ব রামপুরা এলাকায় দুর্জয়দের পাশেই থাকেন সিএনজিচালক স্বপন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "ঘটনার চল্লিশ মিনিট আগেও আমার সাথে দুর্জয়ের কথা হয়, আমার মোবাইলটা একটু খারাপ হইয়্যা গেছিল। ও-ই আমার মোবাইল মাঝে মাঝে ঠিক করে দিত, অথচ আধা ঘণ্টা পরেই তার বীভৎস লাশ দেখতে হলো।" স্বপনের চোখে যেন চিরচেনা প্রিয়জন হারানোর সুর। 

দুর্ঘটনায় নিহত মাইনুদ্দিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মা রাশেদা বেগম পথে বসে আছেন। সারা রাত এক জায়গা থেকে নড়েননি। পূর্ব রামপুরায় নিজের ভাড়াবাড়ির ঘরে তালা ঝুলিয়েছেন। ছেলে ফেরার আগে নাকি ঘর খুলবেন না। তবে ছেলে আর কখনো থাকবে না এ ঘরে। এই তো কয়েক ঘণ্টা আগেও খাটে শুয়ে শুয়ে বলেছে, ভালো কলেজে পড়লেই হবে না; প্রাইভেট লাগবে। খরচ কি চায়ের দোকান থেকে জোগাড় হবে?

সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রামপুরা টিভি রোডের পলাশবাগ এলাকায় বাসচাপায় নিহত হন রামপুরা একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। ভগ্নিপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় অনাবিল পরিবহনের একটি বাস আরেক পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মাইনুদ্দিনকে চাপা দেয়। এতে মাইনুদ্দিন ঘটনাস্থলেই মারা যান।

আড্ডার সঙ্গীর মৃত্যুর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন মাইনুদ্দিনের বন্ধু ও শিক্ষার্থীরা। আতিকুল ইসলাম একরামুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিহত দুর্জয়ের এক ব্যাচ ছোট হলেও বন্ধুর মতোই মিশতেন তারা। তিনি বলেন, 'ছোটকাল থেকেই একই এলাকায় বেড়ে উঠেছি। পড়িও একই স্কুলে। সে আমাদের বন্ধু সার্কেলের। আমাদের মধ্যে সে ছিল ডায়মন্ড। পড়াশোনায়ও ছিল খুব মনোযোগী। গত পরশু শেষ দেখা হয়েছিল। চা খেয়েছিলাম একসঙ্গে। যাওয়ার সময় বলেছিল, দেখা হবে আবার। দেখা হলো, তবে তার লাশের সঙ্গে।'

আতিকুল ইসলাম বলেন, 'গতকাল রাতে ওর নাম্বার থেকে ফোন আসে। কেউ একজন বলে, মাইনুদ্দিন মারা গেছে। আমি ভেবেছিলাম ওর ফোন থেকে কেউ মজা করছে। তাই পাত্তা দিইনি। অনেকক্ষণ পর দেখলাম লোকজন কান্নাকাটি করছে ওর বাসার ওদিকে। তখন শুনলাম সে আসলেই চলে গেছে।'

একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহফুজুল ইসলাম আপন। তিনি বলছেন, 'দেড় বছর আগে মাইনুদ্দিনের সঙ্গে পরিচয়। এরপর থেকে আমরা একসঙ্গেই আড্ডা দিতাম অবসর সময়ে। গত বছর বিধিনিষেধের পর একসঙ্গে সীতাকুণ্ডে ট্যুর দিয়েছিলাম। গত পরশু ওর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেছি। দারুন খেলত ও। খুবই মিশুক স্বভাবের ছিল। কাজেই এক ব্যাচ সিনিয়র হলেও আমরা ছিলাম মূলত বন্ধু। নিশ্চুপ স্বভাবের ছিল। কোনো ঝামেলায় জড়াত না। বন্ধুদের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য হলে সে মীমাংসা করত। এমন কেউ নাই যে ওর কথা শুনত না।'

রাশেদা বেগমের এই ছোট ছেলে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে কিছুদিন আগে পর্যন্ত হালিম বিক্রি করেছেন। মা বানিয়ে দিতেন সেই হালিম। বড় ভাইটি লেখাপড়া করেননি। তাই দুর্জয় চাকরি করে সংসারের হাল ধরার আশ্বাস দিতেন অভাবী মা-বাবাকে। বড় ভাই ব্যবসা করতে অন্যের কাছ থেকে লাখ দুই টাকা ধার নিয়েছিলেন বলে দুশ্চিন্তায় ছিলেন মাত্র ১৭ বছরের মাইনুদ্দিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জমি বিক্রি করে হলেও সে টাকা শোধ করতে মাকে অনুরোধ করছিলেন কয়েক দিন ধরে। 

বোনের বিজয়ের আনন্দ ম্লান হলো দুর্জয়ের মৃত্যুতে

দুর্জয়ের খালাতো বোন আমোদা বেগম গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে বিজয়ী হয়েছেন। মঙ্গলবার সরাইলে নানাবাড়ি গিয়ে বোনের বিজয় উদযাপনে শামিল হওয়ার কথা ছিল মাঈন উদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের। কিন্তু আনন্দের বদলে স্বজনদের জন্য বিষাদের পাহাড় নিয়ে বাড়ি আসছেন দুর্জয়। স্বজনরা এখন অপেক্ষা করছেন তার নিথর দেহের জন্য।

দুর্জয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে। তবে প্রায় ২০ বছর আগে দুর্জয়ের বাবা বাড়িসহ জমিজমা বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসেন। দুর্জয়ের মরদেহ তার নানাবাড়ি সরাইল উপজেলা সদরের হালুয়াপাড়ার পারিবাবিক কবরস্থানে দাফন করার কথা।

দুর্জয়রা তিন ভাইবোন। তার ভাই মনির হোসেন ভাড়ায় গাড়ি চালান।

দুর্জয়ের মৃত্যুতে তার নানাবাড়িতে এখন শোকের মাতম। একমাত্র দেবরের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ভাবি শারমিন আক্তার। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন খালা আফিয়া বেগমও। দুর্জয়ের বড়খালা আফিয়া বেগম জানান, ওর খালাতো বোন আমোদা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। পরীক্ষা শেষে বোনের বিজয়ে আনন্দ করতে আজ নানাবাড়ি আসার কথা ছিল। কিন্তু সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে।'

দুর্জয়ের ভাবি শিরিন আক্তার বলেন, 'আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকত দুর্জয়। আর কেউ আমার বাচ্চার সঙ্গে খেলবে না। আমাকে ডাকাডাকি করবে না। এসব ভাবতেই আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.