সেবা না বাড়িয়ে গাড়ির ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হলে বাড়বে যানজট

বাংলাদেশ

19 October, 2021, 12:40 pm
Last modified: 19 October, 2021, 12:40 pm
সম্প্রতি যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকাগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য আলাদা ফি প্রদান করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনের লক্ষে মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে এর পরেও যানজট কতটুকো কমবে, এ নিয়ে সন্দিহান নগর কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকাগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য আলাদা ফি প্রদান করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

তবে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত ফুটপাত, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা ও পরিকল্পিত গণপরিবহন সেবা চালু না করে এ ধরনের ফি আদায় করলে যানজট না কমে বরং বাড়বে। নাগরিক সুবিধা দিতে স্থানীয় সরকার এ ধরনের কর আরোপ করতে পারে; কিন্তু সেটা সার্বিক বিবেচনা ও পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়া করলে কোনো সুফল আসবে না, অভিমত তাদের।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে বলেন, রাজধানীর গুলশান ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এসব অভিজাত এলাকায় অতিরিক্ত ট্যাক্স দিয়ে গাড়ি চলাচল করতে হবে।

মেয়র আরও বলেন, 'রাস্তায় বের হলে গাড়ি আর গাড়ি। পরিবারের প্রতিটি সদস্যরই আলাদা আলাদা গাড়ি। আমরা পরিকল্পনা করেছি এসব এলাকা দিয়ে গাড়ি চলার সময় এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে। বিদেশে দেখেছি বিভিন্ন রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ঢুকলে এক্সট্রা চার্জ দিতে হয়।'

এসব অভিজাত এলাকাতে মেশিন বসিয়ে প্রথমে গাড়ি গণনা করে একটি সমীক্ষা করে বিষয়টি তারা কার্যকর করবেন বলে জানান মেয়র।

তবে এ ব্যবস্থাকে অত্যন্ত কার্যকরী বললেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না করে হুট করে ব্যবস্থা নিলে উল্টো বিপত্তি ঘটতে পারে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, 'নগর পরিকল্পনায় যখন পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হয়, তখন কন্ডিশন চার্জের কথা বলা হয়। এটা নতুন কিছু না; তবে এর জন্য একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লাগবে।'

এ নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, 'ঢাকাতে বিচ্ছিন্নভাবে কন্ডিশন কর প্রয়োগ করলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এটা করতে হলে পুরো শহরে আগে স্ট্যাডি করে দেখতে হবে, কোন কোন অঞ্চলে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কোথায় কন্ডিশন চার্জ দেওয়া যেতে পারে, সেজন্য একটা এনালাইসিস লাগবে এবং সেটার মূল উদ্দেশ্য থাকবে, কীভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমানো যায়। আর ব্যক্তিগত গাড়ি কমাতে গেলে সে এলাকাগুলোতে গণপরিবহণ ব্যবস্থা, ফুটপাত, পার্কিং এবং অন্যসব সেবা নিশ্চিত করতে হবে।'

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) তথ্যমতে, রাজধানীর ২৯১টি বাস রুটের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোম্পানির ৩০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। এসব রুটের মধ্যে বেশ কয়েকটি রুটই অকার্যকর।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে ঢাকার রাস্তায় ৩,৬৪৩টি বাস-মিনিবাস নামানো হলেও ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নামানো হয় ২,১০৭টি।

২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৫টি, যা মোট গাড়ির ৪৯ শতাংশ। প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হয়েছে তিন লাখ ৮ হাজার ৮৬০টি, যা মোট গাড়ির ১৮ শতাংশ। আর বাসের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৯৭৮টি, যা মোট গাড়ির ২ শতাংশ।

২০১০ সালের দিকে ঢাকায় মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭টি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখেরও বেশি।

বর্তমানে মোট নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ৬৭ শতাংশেরও বেশি, আর বাস বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।

ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকায় দিন দিন তীব্র হচ্ছে যানজট। এই দীর্ঘ যানজটে দিনে কয়েক লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের পুরো জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বসবাস ঢাকা ও এর আশে পাশে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে কয়েকগুণ। গত ১০ বছরে রাজধানীতে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রাজধানীর সড়কে সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে; কিন্তু বর্তমানে রয়েছে ৮ গুণেরও বেশি, যা কোনো মানদণ্ডেই পড়ে না! বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম।

ঢাকায় যানজটের এ পরিস্থিতির মধ্যে অভিজাত এলাকায় কর আরোপ করা হলে নগরবাসী কতটুকো উপকৃত হবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'স্থানীয় সরকারের আইন অনুযায়ী নগরবাসীর জীবনমানকে সহনীয় রাখতে যেকোনো ধরনের ফি কিংবা টোল আরোপ করার পূর্ণ স্বাধীনতা সিটি করপোরেশনের আছে। আইনগত দিক থেকে প্রতিবন্ধকতা নেই; কিন্তু এপ্লিকেশনের দিক থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ফাংশনাল করতে হবে। বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন না করে এমন সিদ্ধান্ত নিলে ভোগান্তি কমবে না; বরং বাড়বে।'

তবে উত্তরের মেয়র বলছেন, 'ফুটপাত দখলমুক্ত করে পার্কিংয়েরও পরিধি বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, 'নগরীতে বড় বড় ফুটপাত নির্মাণ করা হলেও বিভিন্ন কায়দায় সেগুলো দখল হয়ে যায়, আর ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না পেরে জনগণকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়; ফলে যানজট বৃদ্ধি পায়। সুস্থ্যতার জন্য লোকজন যাতে নির্দিষ্ট জায়গায় সাইকেল চালাতে পারে এবং ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে, সেজন্য আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।'

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বিআরটিএ আমাদের ট্রান্সপোর্টের জন্য রেজিস্ট্রেশন রুট পারমিট এবং সবগুলো দিয়ে একটা ট্যাক্স নিচ্ছে সরকার। সেই ট্যাক্সের বলে তারা সারা বাংলাদেশে ঘুরতে পারবে শুধু যেখানে যেখানে টোল আছে, সেখানে দিতে হবে। গুলশান, বনানীতে স্পেশাল কিছু না দিয়ে তো গাড়ির ওপর কর নির্ধারণ করতে পারে না। ট্যাক্স নিতে হলে অবশ্যই সে অনুযায়ী সেবা দিতে হবে।'

শুধু ট্যাক্স নিলেই কি যানজট কমবে? এতে আরও যানজট বাড়বে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, 'অন্য কোনো ব্যবস্থা থাকলে সেটা করা উচিত যানজট কমাতে, ট্যাক্স নির্ধারণ করে যানজট কমানো সম্ভব না। এটা কোনো সাসটেনেবল সিসটেম না। প্রাইভেট কার বেড়ে গেছে, এর চাপ কমাতে অবশ্যই গণপরিবহনের সেবা বাড়াতে হবে। স্পেশাল কোনো রাস্তা করে সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে অন্য কোনো সময়ে এইসব যানবাহন চলবে না, এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে।'

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, গাড়িপ্রতি অতিরিক্ত ট্যাক্স বসাতে হলে স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় কোনো সুফল মিলবে না। উল্টো যানজট আরও বাড়বে। বিদেশে যেসব স্বীকৃত পদ্ধতি আছে, তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এজন্য রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী ও যাতায়াতকারী প্রতিটি পরিবারের জন্য গাড়ি নীতি করতে হবে, যাতে একটি পরিবার একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে না পারে। একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করলে অতিরিক্ত ট্যাক্স দিয়ে চলতে হবে এমন ব্যবস্থাও পরামর্শ দেন তারা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.