সামাজিক ঐক্য রাখতে একক শিক্ষা কারিকুলাম জরুরি

বাংলাদেশ

22 March, 2021, 07:50 pm
Last modified: 22 March, 2021, 07:49 pm
স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উভয় ক্ষেত্রেই এ বছরটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে আমাদের প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা একটি একক শিক্ষা ব্যবস্থা আদলে করা যায় কিনা সে প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা উচিত।

ভাষা ও আমাদের স্বাধীনতা পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক আজ ৫০ বছর পরে তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার চিন্তা স্বপ্ন সব কিছুই শুরু হয়েছিল ৪৭ উত্তর ভারত বিভাগের খুব অল্প পরেই। আমরা যখন দেখলাম সেই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে তাচ্ছিল্যের সাথে পরিত্যাগ করে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তখনই আমাদের সেই সময়ের নেতৃবৃন্দ-বঙ্গবন্ধুসহ-সবাই অনুধাবন করেছিলেন যে, হাজার মাইল দূরের দুটি ভূখণ্ড কখনো এক থাকতে পারে না। তাদের চিন্তার জগতে ধর্মবিশ্বাসের জায়গাটা বাহ্যিকভাবে এক হলেও কার্যকরভাবে এর নানান শাখা-প্রশাখা, নানানভাবে দ্বিধা-বিভক্ত।
 
মুসলিম ধর্মাবলম্বী শিয়া-সুন্নির পরেও আরো বহু বিভাজন আছে। এ বিভক্তি যা আমাদের সমাজে সুস্পষ্ট সেখানে শুধু ধর্মবিশ্বাসের জোরে হাজার মাইল দূরের অরেকটি ভূখণ্ডের মানুষের সঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য বোধ না করাটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর নানান দেশে ধর্মকে ব্যক্তিপর্যায়ে রেখে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে। 

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। ৬৯ বছর পরে আজকে আমাদের ভাবতে হবে সেই ভাষা আমরা কতটা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। স্বল্পকাল আগেও আমরা পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি উচ্চ-আদালতে আমাদের ভাষা হিসেবে বাংলা সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উচ্চ আদালতের মামলার আলোচনা পর্ব মামলার সাধারণভাবে বাংলা এবং ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে হয়ে থাকে, কিন্তু বিচারক সাহেবরা রায় লেখার ক্ষেত্রে এখনো শতভাগ বাংলা গ্রহণ করতে পারেন নাই। তাদের পক্ষের নানান যুক্তি আছে: বাংলায় প্রতিশব্দের অভাব কিংবা ইংরেজি শব্দের প্রকৃত বাংলা শব্দ খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি।

৫০ বছর পরেও কেন আমরা তা করতে পারলাম না, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অল্পক্ষণ পরেই যে সরকার দেশ চালানোর দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেন তারা বাংলাভাষাকে ও  বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গা থেকে সরতে শুরু করলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করলেন। আবার এর পাশাপাশি এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করলেন যার ফলে উচ্চবিত্ত ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ক্রমান্বযয়ে ঝুঁকে পড়ল। পরিণতিতে আজকে আমরা দেখতে পাই যে ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যম কিভাবে বিকশিত হয়েছে। ঢাকাসহ অন্য বড় শহরগুলোয় বেসরকারি খাতে বেশ কিছু বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা কেবলমাত্র ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করে থাকে।

দেশের বিত্তশালী ধনিক শ্রেণী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আমলা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অধিকাংশই ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। দুঃখজনক হলেও সত্যি, দেশের জন্য একটি একক কোন প্রাইমারি শিক্ষা কারিকুলাম গড়ে উঠে নাই। একদিকে যেমন ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার তেমনি আরেকদিকে আরবি ভাষা শিক্ষা—আমাদের দেশে এখন মোটামুটিভাবে বলা যায় তিন ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা, বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল কিংবা মাধ্যমিক স্কুলের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আর তৃতীয় যে শিক্ষাব্যবস্থাটি দেশে গড়ে উঠেছে, আরবী। এই শিক্ষা ব্যবস্থার নাম মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আবার দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে একটি সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আরেকটি পুরোপুরি বেসরকারিভাবে পরিচালিত। যাদের আমরা কওমি মাদ্রাসা নামে চিনি। এই কওমি মাদ্রাসা বা মাদ্রাসার ছাত্ররা দেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় নেমেছে, প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং এখানে উল্লেখ করা যায়: তাদের এই অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস শাপলা চত্বর থেকে শুরু হয়েছে যা এখনও বিদ্যমান। এরাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা এবং দেশের নানা প্রান্তে ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টির মতন পরিবেশ সৃষ্টি করছে বিভিন্ন সময়ে। কওমি মাদ্রাসার প্রণীত সিলেবাস, যেখানে আরবি ভাষাই মূল এবং যথেষ্ট জটিল একটি শিক্ষা ব্যবস্থা, যা কিনা পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে আছে তা বলা দুষ্কর! খুঁজলে যে কয়েকটি দেশের উদাহরণ পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম পাকিস্তান। পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ কওমী মাদ্রাসার মতো একটি জটিল শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে।

বাংলাদেশের আগামী ভবিষ্যৎ কোন দিকে তা যেমন অনুমান করা প্রয়োজন রয়েছে তেমনি আমলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কও। পাকিস্তান দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার অথবা পাকিস্তানের মতনই বহুধা বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উভয় ক্ষেত্রেই এ বছরটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে আমাদের প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা একটি একক শিক্ষা ব্যবস্থা আদলে করা যায় কিনা সে প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা উচিত। পশ্চিমা দেশগুলোতেও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে গির্জা পরিচালিত স্কুলে। যেখানে বাইবেল শেখানো হয় আবার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কারিকুলামও অনুসরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কারিকুলাম অস্বীকার করে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় না। সেই জায়গা থেকেই বলা যায়; বঙ্গবন্ধুর একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল, তা বাস্তবায়ন করতে চাইলে একটি একক সার্বজনীন বাধ্যতামূলক কারিকুলাম প্রণয়ন করা জরুরি। যা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। একক কারিকুলাম না হলে ইংরেজি ভাষা ও আরবি ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম যেভাবে সমাজকে প্রভাবিত করছে, তার ফলে আগামীতে বাংলাদেশের সামাজিক ঐক্য গড়ে ওঠা বা বজায় রাখা খুবই দুষ্কর হবে।

  • লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.