রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এ অঞ্চলে নিরাপত্তার হুমকি: প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট
11 November, 2019, 01:05 pm
Last modified: 11 November, 2019, 06:07 pm
'এই হুমকির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাাচ্ছি'...

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক শুধু বাংলাদেশের নয় এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

তিনি বলেন, "এই হুমকির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাাচ্ছি।"

সোমবার (১১ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ঢাকা গ্লোবাল ডায়ালগ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস (বিস) এবং ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) যৌথভাবে তিনদিন ব্যাপী এই ডায়ালগের আয়োজন করেছে।

উন্নয়নের জন্য শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় রাখাটা জরুরী আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে টেকসই প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিষয়টি অনুধাবন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন দেশগুলোর অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক।

তিনি বলেন, সমুদ্রসীমা ও সামুদ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ মনে করে, পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা বা ‘জিরো-সাম গেম’ বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগরের ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। বরং তা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আমি আরও মনে করি, সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার ও এর মাধ্যমে ‘নীল অর্থনীতির’ টেকসই উন্নয়নের জন্য সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সহায়তাপূর্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ ও সমতাপূর্ণ সম্পর্ক আবশ্যক।"

এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদারকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ সর্বদা বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক জোরদারে সচেষ্ট। বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করেছে। সমস্যা সমাধানে আমাদের এরূপ সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা অন্য অঞ্চলের জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে।”

প্রতিবেশির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁর পররাষ্ট্র নীতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পদাঙ্ক- “সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়” মেনে চলছে, বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার প্রদর্শিত এই পথে আমরা আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপনে অঙ্গীকারবদ্ধ।”

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় জলদস্যুতা, সশস্ত্র ডাকাতি, উপকূলবর্তী ও সামুদ্রিক এলাকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ, মানবপাচার, অস্ত্র ও মাদক পাচার- এর মত অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসনে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কোন একক দেশের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।”

তিনি বলেন, মাছসহ সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ ও নানাবিধ দূষণ এই এলাকার সামুদ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে। শুধু বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর নয়, বিশ্বের সকল সাগর-মহাসাগরই আজ এ ধরনের বহুবিধ সমস্যায় আক্রান্ত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোতে যোগ হচ্ছে ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য। দূষণ ও সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানকে বিনষ্ট করছে। পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা।

শেখ হাসিনা বলেন, “এই সকল সমস্যা সমাধানে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব জোরদার করার জন্য আমি সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মনে করে, এই সহযোগিতা হতে হবে সকলের অংশগ্রহণমূলক এবং সবার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে।”

ভৌগোলিক কারণে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই স্থান দিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ অতিক্রম করেছে, যা এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতিসমূহের জ্বালানি ও রসদের যোগান দেয়।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বের কনটেইনার শিপমেন্টের অর্ধেক এবং সমুদ্রবাহিত তেল বাণিজ্যের শতকরা ৮০ ভাগ অতিক্রান্ত হয় ভারত মহাসাগর দিয়ে। বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের শতকরা ১৬ দশমিকব ৮ ভাগ ও প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের শতকরা ২৭ দশমিক ৯ ভাগ এই মহাসাগর ও তৎসংলগ্ন সাগরসমূহে অবস্থিত।”

“এই অঞ্চলে সারা বিশ্বের শতকরা ২৮ ভাগ মৎস্য আহরিত হয়”, উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বিপুল সম্পদের উৎস এবং কৌশলগত কারণে ভারত মহাসাগর বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।”

বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগই সমুদ্রপথে হয়ে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘এই সমুদ্র বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার উপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সমুদ্রসীমার বিশাল এলাকা বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্পদের উৎস। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই সম্পদের সদ্ব্যবহার অনেকাংশে নির্ভর করে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার উপর।

তিনি বলেন, গ্যাস ছাড়াও ভারত মহাসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ মৎস্য, খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ আছে। সুষ্ঠু ও পরিবেশসম্মত পরিকল্পনা এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সম্পদ এই এলাকার দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করা সম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, "একটি হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ তার সমগ্র ভূ-খন্ডে যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদন করে, তার প্রায় সমপরিমাণ সম্পদ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্য থেকে আহরণ করা সম্ভব।"

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত মহাসাগরকে ঘিরে মোট ৪০টি উন্নয়নশীল দেশের অবস্থান। সেখানে বাস করে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আছে ৬টি দেশ। আরও কয়েকটি দেশ যেমন: নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যদিও বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত নয়, তবুও তাদের অর্থনীতিতে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী ও নির্ভরশীল দেশগুলোর অর্থনীতি ও তাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন এই সাগর ও মহাসাগর দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সাগর ও মহাসাগরের সম্পদ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান সরাসরি এই দেশগুলোর অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে।’

‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ইন্দো-প্যাসিফিক’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শুরু হওয়া এ ডায়লগে বিভিন্ন দেশের ১৫০ জনেরও বেশি আলোচক অংশ নিবেন।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং ওআরএফ প্রেসিডেন্ট সমির সরণ। তার আগে বিআইআইএসএস মহাপরিচালক একেএম আব্দুর রহমান স্বাগত বক্তব্য দেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.