রেশম চাষে স্বাবলম্বী গাজীপুরের এই নারীরা

বাংলাদেশ

22 November, 2020, 12:20 pm
Last modified: 22 November, 2020, 12:59 pm
সরকারী এই উদ্যোগে তুঁত গাছ, রেশম গুটি ও সুতা সংগ্রহ পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে রেশম বোর্ড। কাপাসিয়ার রেশম চাষী নারীদের নির্বিঘ্ন চাষও বাজারজাতের কারণে কয়েক মাস পরেই তারা ভালো টাকা আয় রোজগার করতে পারেন। রেশম গাজীপুরের অনেক পরিবারের মুখেই স্বচ্ছলতার হাসি এনে দিয়েছে।

কাপাসিয়া উপজেলার নিভৃত দুই গ্রাম বরহর ও দিঘিরকান্দা। এ গ্রাম দুটির অধিকাংশ লোকজনই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এই কৃষিজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে খানিকটা সস্তি হয়ে এসেছে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের রেশম প্রকল্প। রেশম চাষে সংসারে বাড়তি রোজগার করছেন গাজীপুরের এই দুই গ্রামের নারীরা।

এই দুই গাঁয়ের কৃষানীরা এখন নিজেদের স্বাবলম্বী ভাবতে শুরু করেছে। এসব নারীদের রেশম চাষে উদ্বুদ্ধ করছে রেশম বোর্ড। শুরুতে অনেকের অনাগ্রহ থাকলেও কয়েক বছরেই মধ্যেই রেশম চাষে লাভের মুখ দেখা মেয়েদের দেখাদেখি অনেকেই আগ্রহী হয়। এখন রেশমে বদলে গেছে দুই গ্রামের অনেক নারীর জীবন। 

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার করিহাতা ইউনিয়নের দিঘিরকান্দা ও রায়েদ ইউনিয়নের বরহর গ্রাম দুটি গ্রামের বাড়ি বাড়ি তৈরী হয়েছে রেশম চাষের পলু ঘর। 

বরহর গ্রামের জাহেদা আক্তার রেশম চাষে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তার স্বামী মাঠে কাজ করেন। স্বামীর স্বল্প আয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের নানা খরচ যোগানে হিমশিম খেতে হতো। ৫ বছর আগে তিনি রেশম চাষ শুরু করেন। রেশম চাষের মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০হাজার টাকা সংসারে যোগান দেন তিনি। এতে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া খরচ চলানোসহ সংসারের খরচ চালিয়ে খানিকটা হলেও স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন।

এই গাঁয়েরই বধু শিল্পী রানী বলেন, তাদের হিন্দু পল্লীতেও এখন রেশম চাষে ঝুঁকছে নারীরা। সংসারের কাজের পর বাকি সময়টা ঘরে বসে একজন নারী হিসেবে বাড়তি আয় করতে পারছেন তিনিও। আগে নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য স্বামীর দিকে চেয়ে থাকতে হতো। এখন ঘরে বসেই তিনি আয় করতে পারেন। নিজের ও সন্তানদের খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতেও টাকা তুলে দিতে পারেন। 

রেশম চাষে ব্যস্ত নারীরা। ছবিটি গাজীপুরের বহরমপুর গ্রাম থেক্ব তোলা।

দিঘিরকান্দা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, কিছুদিন আগেও অভাবের সংসার ছিল তার। অভাব মোচনে তার স্ত্রী রেশম চাষ শুরু করেন। তিনি মাঠে কাজ করেন, আর তার স্ত্রী বাড়িতে রেশম ও গবাদি পশু পালন করেন। এতে কয়েক বছরেই তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

গাজীপুরের কাপাসিয়া রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সুপারভাইজার গোলাম ছহুরুল আলম জানান, আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র গাজীপুরের অধীনে কাপাসিয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় রেশম চাষ হচ্ছে। গোড়ায় গাজীপুরের কাপাসিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যেই এ চাষের শুরু, বেশ কয়েক বছর আগে। সমন্বিত প্রকল্পের অধীনে রেশম চাষে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে এই চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়। দুই গ্রামের ৬৪ জন নারীর বাড়ীতে পলু ঘর নির্মাণসহ যাবতীয় আনুসাঙ্গিক কাজে সাহায্য করেছে রেশম বোর্ডের তরফ থেকেই।

রেশম পোকার খাবারের জন্য স্থানীয় বরদার খালের দুই পাড়েই ৫ কিলোমিটার এলাকায় তুঁত গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া সরকারী এ কর্মসূচীর বাইরে বাড়ি বাড়ি রেশম চাষ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে রেশম বোর্ড থেকে চলতি বছর অনেক বাড়িতে রোপনের জন্য বিনামূল্যে তুত গাছ দেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে এই উদ্যোগের আওতায়। 

প্রতিটি বাড়িতে রেশম কীট (লার্ভা) বিতরণ থেকে গুটি তৈরী পর্যন্ত সবকিছু তদারকি করে রেশম বোর্ড। পরে উৎপাদিত গুটি কৃষকদের কাছ থেকে কেজি দরে কিনে নিয়ে সুতা উৎপাদন করা হয়। বছরে চারবার রেশম গুটি উৎপাদন করা যায়। প্রতি বছরে ভাদ্র, অগ্রহায়ন, চৈত্র ও জৈষ্ঠ মাসে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়। রেশম পোকা ডিম পাড়ার কয়েকদিনের মধ্যেই পোকা তৈরী করে। পোকার খাদ্য হিসেবে তুঁত গাছের পাতা কেটে কুচি কুচি করে খাওয়ানো হয়। এই পাতা খেয়ে পোকাগুলো ২০/২৫দিনের মধ্যেই গুটি তৈরী করতে শুরু করে। আর এ গুটি থেকেই তৈরী হয় রেশম সুতা। বর্তমানে এক কেজি সুতা বিক্রি হয় ৩৫০০টাকায়। প্রতি ১০/১২ কেজি গুটি থেকে ১ কেজি সুতা উৎপাদন করা যায়।  

গাজীপুরে রেশম চাষ সম্প্রসারণে সরকারি খালের দুইপাশে ৫ কিলোমিতার রাস্তা জুড়ে লাগানো হয়েছে তুঁত গাছ।

গাজীপুরের জোনাল রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গাঁয়ের নারীদের স্বাবলম্বী করতেই রেশম চাষ সম্প্রসারনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ রেশম শিল্প সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল কাপাসিয়ার অর্ধশত পরিবারে। এখন আরও পরিবার এই চাষে যুক্ত হয়েছে। প্রতি তিন মাসে একজন রেশম চাষী কমপক্ষে ৭/৮হাজার টাকা আয় করেন। 

রেশম বোর্ড জানায় বছরে চারবার গুটি উৎপাদন করা যায়। বিনামূল্যে তুঁত চারা ও রেশমপোকা সরবরাহ করে রেশম বোর্ড। তুঁত গাছ চারা থেকে পরিণত হতে ২/৩ বছর সময় লাগে। পলু ঘরে ঢালায় রেশমপোকা ও তাদের পর্যাপ্ত তুঁতপাতা সরবরাহ করলে ২০/২৫ দিনের মধ্যে গুটি পাওয়া যায়। গুটি তৈরি হওয়ার ৩/৪দিন পর রোদে শুকিয়ে নিতে হয়, যাতে ভেতরের পোকা মারা যায়। পরে তা বিক্রির উপযোগী হয়। 

মো. আবুল কালাম আজাদ আরো জানান, রেশম চাষের প্রধান রসদই হচ্ছে পোকার খাবার, এই খাবার আসে তুঁত গাছের পাতা থেকে। রেশম পোকার খাবার সরবরাহের জন্য সরকারী বিভিন্ন খাল ও নদীর পাড়ে তুঁত গাছ রোপন করা হচ্ছে। এতে কোন জমিরও অপচয় হচ্ছে না।

সরকারী এই উদ্যোগে তুঁত গাছ, রেশম গুটি ও সুতা সংগ্রহ পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে রেশম বোর্ড। কাপাসিয়ার রেশম চাষী নারীদের নির্বিঘ্ন চাষও বাজারজাতের কারণে কয়েক মাস পরেই তারা ভালো টাকা আয় রোজগার করতে পারেন। রেশম গাজীপুরের অনেক পরিবারের মুখেই স্বচ্ছলতার হাসি এনে দিয়েছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.