যশোর জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউতে হৃদরোগ চিকিৎসার করুণ হাল

বাংলাদেশ

16 September, 2021, 12:20 pm
Last modified: 16 September, 2021, 12:31 pm
চালু হওয়ার ১০ বছর পরেও, হাসপাতালের সিসিইউতে হৃদরোগের কোন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা নেই। ৭৮ জন জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠানোর পর ২৮ পদে অনুমোদন মিললেও এক বছরের বেশি পেরোলেও সেই জনবল দেয়া হয়নি। আবার বাকি ৫০টি পদের অনুমোদনে সাড়া মিলছেনা। উন্নত চিকিৎসার অভাবে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অনেক মানুষের প্রাণ। হৃদরোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিই নষ্ট। ইকো মেশিনটি সচল থাকলেও দেড় বছরের বেশি সময় ধরে রোগীদের ইকো করা হয়না। হৃদযন্ত্রের প্রয়াজনীয় পরীক্ষার জন্য ছুটতে হচ্ছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে করোনারি কেয়ার ইউনিটের তিনতলা ভবন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর নিজস্ব জনবল ছাড়াই উদ্বোধন হয় যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিটের। কিন্তু জনবলের অভাবে বন্ধ ছিল চিকিৎসা কার্যক্রম। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৪ জন চিকিৎসক, ৫৬ জন নার্স ও ১৪৩ জন কর্মচারী নিয়োগের চাহিদাপত্র পাঠায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু কয়েক দফায় ইউনিটটি চালুর সময় পিছিয়ে যায়। শেষে নানা সংকটের মধ্যে ২০০৯ সালের ১২ জুলাই যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জনবল দিয়েই শুরু হয় চিকিৎসা কার্যক্রম। সেই থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বিভাগটি।  

২০২০ সালে ৭৮ জন জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। এরমধ্যে চিকিৎসকের পদ ছিল ২০টি, সেবিকার পদ ছিল ৩০টি ও ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদ ছিল ২৮টি। কিন্তু ২৮ জনের পদের অনুমোদন মেলে। এরমধ্যে ১২ জন চিকিৎসক, ১ জন নার্সিং সুপারভাইজার, ১২ জন সেবিকা ও ২ জন কার্ডিওগ্রাফার। চিকিৎসকের পদে রয়েছেন কার্ডিওলজি বিভাগের  সিনিয়র কনসালটেন্ট ১ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট ১ জন, আবাসিক চিকিৎসক ১ জন,  সহকারী রেজিস্ট্রার ১ জন, সহকারী সার্জন ও মেডিকেল অফিসার ৬ জন ও ইমাজেন্সি মেডিকেল অফিসার ২ জন। এরমধ্যে ১ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট, ১ জন সহকারী রেজিস্ট্রার ও ১ জন রেডিওগ্রাফার যোগদান করেছেন। বাকি পদে জনবল সৃষ্টির ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ নিশ্চিত করেছে।

বর্তমানে ১২ পদের বিপরীতে মাত্র দুই জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট ও মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসকরা বাড়তি দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু যন্ত্রপাতির অভাবে তারা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্রে সুস্থ না হলে রোগীকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন তারা। 

এদিকে, কার্যক্রম চালুর পর পর্যায়ক্রমে ইকোকার্ডিও গ্রাম, ইটিটি, কার্ডিওয়াক মনিটর, কালার ডপলার, ডিজিটাল ইসিজি মেশিন বরাদ্দ মেলে। কিন্তু সেগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় অকেজো হয়ে গেছে। পরে বরাদ্দ পাওয়া আরও একটি অত্যাধুনিক ইকো মেশিন রোগীদের পরীক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে না দেড় বছরের বেশি সময় ধরে। অথচ রোগীর হার্টের প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য ইকো করতে হয়। রোগীর হার্টে কোনো ছিদ্র আছে কিনা, বাল্ব ঠিক আছে কিনা, হার্টে পানি জমে কিনা, শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক আছে কিনা তাও জানতে ইকোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে ইকো বন্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিকিৎসকের এক সহকারী জানিয়েছেন, করোনাকালে হাসপাতালে ইকো পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে চিকিৎসকদের পরিচিত কেউ হলে করে দেন। 

সূত্র জানায়, সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে ইকো করতে ২০০ টাকা খরচ হলেও বাইরের ক্লিনিকে এই পরীক্ষা করাতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ব্যয় হয়। যা দরিদ্র রোগীদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে যায়। একইভাবে সরকারি হাসপাতালে ইটিটি করতে লাগে ৩০০ টাকা, অথচ বাইরে এটি করাতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এ ব্যয় বহন করা অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, করোনারি কেয়ার ইউনিটে মোট ২৮টি শয্যা রয়েছে। সেখানে ভর্তি থাকেন শতাধিক রোগী। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৫ শতাধিক রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। শুধু যশোর নয়, নড়াইল, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার রোগীরা এখানে আসেন চিকিৎসা নিতে। তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র মানুষ। কিন্তু ইসিজি ছাড়া হৃদরোগে আক্রান্তদের অন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগের রোগীদের সব পরীক্ষা হাসপাতালের বাইরের ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক থেকে করিয়ে আনতে হয়। এতে করে রোগীদের হয়রানি ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গুনতে হচ্ছে বাড়তি পরিমাণ অর্থ। সিসিইউতে নিয়মিত ইকো করা হলে সরকারি রাজস্ব বাড়বে। আবার রোগীরাও আর্থিক ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে। 

একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনেরা জানান, করোনারি কেয়ার ইউনিটে প্রয়োজনের সময় চিকিৎসক ডেকেও পাওয়া যায় না। সকালে চিকিৎসকরা রাউন্ডে আসেন। কিন্তু বিকেলের পর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলে না। আর জরুরি বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রারের পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করেন ইন্টার্ন। ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদের ঠিকমতো কার্যক্রম চালানো হয় না। বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে লোক ভাড়া করে ইসিজি করতে হয় অধিকাংশ সময়। 

সিসিইউতে চিকিৎসাধীন যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি এলাকার এক রোগীর স্বজন জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা মেলে খুব কম। সেবিকারা মাঝেমধ্যে আসেন, প্রেসার মাপেন। অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে। এখানে উন্নত চিকিৎসা বলতে কিছু নেই। রোগীর সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়েছে। রোগীর অবস্থা একটু খারাপ মনে হলেই ঝুঁকি নিয়ে রোগীকে রাখেন না চিকিৎসকেরা। তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। গত ৪ জুলাই মতিনুজ্জামান মিটু নামে একজন অসুস্থ হয়ে করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হন। চিকিৎসক তাকে ঢাকায় রেফার করেন। ৭ জুলাই তাকে ঢাকা নেয়া হয়েছিল।

যশোর নাগরিক আন্দোলনের নেতা ইকবাল কবির জাহিদ জানান, "দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হৃদরোগে আক্রান্ত অনেক রোগীকে যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিটে আনা হয়। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে রোগীর সংকটাপন্ন মুহূর্তে অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন ও কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনসহ উন্নত সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জোরালো দাবি জানাচ্ছি"।

করোনারি কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক তৌহিদুল ইসলাম জানান, "প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী না থাকায় রোগীরা উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন"। 

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান জানান, "করোনারি কেয়ার ইউনিটের জন্য জনবল ও যন্ত্রপাতি পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসেও একটি চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি নষ্টের বিষয়টি জানানো হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। পর্যাপ্ত জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ না পেলে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা সত্যিই কষ্টকর"।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়মিত ইকো পরীক্ষার ব্যাপারে কার্যকরী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.