মালোপাড়ার জেলেদের দুঃখ তিতাস
কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাসের কোল ভরা জল, বুক ভরা ঢেউ আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাসের কথা বর্ণনা করেছিলেন। ফুটিয়ে তুলেছিলেন মালোপাড়ার জেলেদের জীবনযুদ্ধের চিত্র। কিন্তু তিতাসের সেই ভরা যৌবন আর নেই। দখল আর দূষণের ফলে দিন দিন জরাজীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে তিতাস। যে তিতাস মালোপাড়ার জেলেদের জীবনের সবকুটু জুড়ে, সেই তিতাসই এখন তাদের একমাত্র দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদীতে আর আগের মতো মাছ নেই, যা আছে তাও কারেন্ট জাল দিয়ে এবং ঘের বানিয়ে আহরণ করছেন অন্য জেলেরা। এতে করে মানবেতর দিন কাটছে মালোপাড়ার জেলেদের।
মালোপাড়ার বাসিন্দা নির্মল মল্লবর্মণ তিতাস নদীতে মাছ ধরছেন প্রায় ৫০ বছর ধরে। ভরা তিতাসের বিভিন্ন স্থানে জাল ফেলে মাছ ধরেতেন দলবেঁধে। বছর দশেক আগেও তার জালে ধরা পড়তো বড় বোয়াল, আইড়, চিংড়ি, পাবদা ও মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তখন এক সপ্তাহ জাল ফেলে যে মাছ ধরতেন তা বিক্রি করেই ভালোভাবে এক মাস চলত তার সংসার। কিন্তু এখন আর নদীতে আগের মতো মাছ না পাওয়ায় কষ্টে দিন কাটছে তার। অনেকবার পেশা পরিবর্তন করার কথা ভাবলেও পূর্বপুরুষের পেশা হওয়ায় ছাড়তে পারেননি তিনি।
তবে মালোপাড়ার অনেক পরিবার এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তাদের কেউ দর্জি, কেউ সেলুন, কেউবা কাঠমিস্ত্রির কাজ করে দিন যাপন করছেন।
জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি উপজেলা দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস নদী। এই তিতাস নদীতেই মালোপাড়ার জেলেদের জীবন ও জীবিকা। আর শহরের গোকর্ণ ঘাট এলাকায় তিতাস নদীর পাড়েই মালোপাড়ার অবস্থান। মালোপাড়ায় ঢোকার পথেই রয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের আবক্ষ মূর্তি। বর্তমানে মালোপাড়ায় বসবাস করেন শতাধিক জেলে পরিবার। এর মধ্যে মাত্র ২০-২৫টি পরিবার মাছ ধরা পেশায় জড়িত রয়েছে।
এক সময় নদীতে জাল ফেললেই নানা প্রজাতির মাছ ঝাঁকে-ঝাঁকে ধরা পড়তো। সেই মাছ বাজারে ভালো দামে বিক্রি করে চলত জেলে পরিবারগুলো। কিন্তু এখন আর আগের সেই চিত্র নেই। তিতাসের দুই পাড়ে অবৈধ দখল আর দূষণের কারণে দিন দিন জরাজীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ নদীটি। বাসা-বাড়ি ও হোটেলের বর্জ্য ফেলা হয় নদীর পাড়ে। আর প্রভাবশালীরা দখল করেছেন নদীর পাড়। দীর্ঘদিন ধরে খননকাজ বন্ধ থাকায় পলি জমেছে নদীতে। বর্তমানে খনন কাজ শুরু হলেও সেটি ধীরগতি চলছে।
এছাড়াও নদীর বিভিন্ন স্থানের চারপাশে বাঁশ পুঁতে শত শত ঘের বানানো হয়েছে। এই ঘের বানানোর ফলে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি হচ্ছে। এতে করে মাছ নদীতে অবাধ বিচরণের সুযোগ পাচ্ছে না। বড় হওয়ার আগেই কারেন্ট জালে আটকা পড়ছে। ঘেরের পাশে জাল ফেলতে গেলে বাধা দেয়া হয় বলে অভিযোগ মালোপাড়ার জেলেদের। এ নিয়ে প্রতিবাদ করারও সাহস নেই তাদের।
নির্মল মল্লবর্মণ বলেন, নদীতে মাছ ধরেই সংসার চলে আমার। এই মাছ বিক্রি করেই ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা শিখাচ্ছি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ১০ বছর আগেও প্রচুর মাছ পেয়েছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। নদীতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো করে ঘের বানিয়ে এবং কারেন্ট জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরছে।
তিনি আরও বলেন, ঘেরের সামনে আমাদের জেলেরা জাল ফেললেই বাধা দেয়া হয়। এই ঘেরের কারণে মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায়না। কারণ ঘের এলাকাটি চরের মতো হয়ে যায়। আমাদের দাবি থাকবে, নদীটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে আমাদেরকে সব জায়গায় মাছ ধরার সুযোগ দেওয়া হোক।
মালোপাড়ার বাসিন্দা নগীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ জানান, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিতাস নদীতে মাছ ধরেন তিনি। মাছ বিক্রি করেই চলে তার সাত সদস্যের পরিবার। আগে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সেই মাছ বিক্রি করে সংসার ভালোভাবেই চলত। ১০-১৫ বছর আগেও নদীতে অনেক পানি ছিল, এখন দখলের কারণে শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। গত ৭/৮ বছর ধরে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। কারণ, মাছ বড় হওয়ার সুযোগই দেওয়া হয় না। মালোপাড়ার বাইরের জেলেরা নদীতে ঘের বানিয়ে মাছ ধরে। আমরা জাল ফেলতে গেলে বাধা দিয়ে গালিগালাজ করে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস নেই আমাদের। এই তিতাস নদী এখন আমাদের কাছে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই না।
মালোপাড়ার বাসিন্দা সুকুমার বর্মণ বলেন, ১০-১৫ বছর নদীতে মাছ ধরেছি। এখন আর মাছ ধরি না। ঘের বানিয়ে অন্য জেলেরা এখন মাছ ধরে। আমাদের নদীর সব জায়গায় মাছ ধরতে দেয়া হয় না। এক ঘের মালিক আমাকে মাছ ধরতে যাওয়ার পর গালিগালাজ করেছিল। এরপর থেকে মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করি।
আরেক জেলে শেতন বর্মণ জানান, তিনিও বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে তিতাস নদীতে মাছ ধরেন। কিন্তু এখন মাছ কম পাওয়ায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য তিনি মাছ ধরার পাশাপাশি সেলুনে কাজ করেন। এতে করে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ দখল এবং ঘেরগুলো উচ্ছেদ করছি। তিতাস নদী একটি উন্মুক্ত জলাশয়। এই উন্মুক্ত জলাশয়ে কাউকে ঘের বানিয়ে পানি প্রবাহ এবং মাছের অবাধ বিচরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। নতুন করে ঘের হয়ে থাকলে সেগুলো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উচ্ছেদ করা হবে।